
পাকিস্তান-শাসিত কাশ্মীরে এক অস্বস্তিকর অবস্থা বিরাজ করছে। শুক্রবার (৩ অক্টোবর) ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ বা সম্পূর্ণ বন্ধের পঞ্চম দিনেও এই অঞ্চলটি অশান্ত রয়েছে। সবশেষ তথ্য অনুসারে, বিক্ষোভকারী এবং নিরাপত্তা বাহিনীর মধ্যে সহিংস সংঘর্ষে কমপক্ষে ৯ জন নিহত হয়েছেন – যার মধ্যে তিন জন পুলিশ কর্মকর্তাও রয়েছেন। সংঘর্ষ অব্যাহত থাকায় উভয় পক্ষের আরও অর্ধশতাধিক আহত হয়েছে।
এ অবস্থায় পাকিস্তান সরকার বৃহস্পতিবার আজাদ কাশ্মীরের রাজধানী মুজাফ্ফরাবাদে আলোচনার জন্য একটি প্রতিনিধিদল পাঠিয়েছে। তারা জম্মু-কাশ্মীর জয়েন্ট আওয়ামী অ্যাকশন কমিটি (JAAC)-এর সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক করবে। জেএএসি এই অঞ্চলের তৃণমূল স্তরের অসন্তোষের কণ্ঠস্বর হিসেবে পরিচিত ব্যবসায়ী এবং নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিত্বকারী একটি সংগঠন।
সংগঠনের নেতা শওকত নওয়াজ মীরের নেতৃত্বে জেএএসি-আয়োজিত ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ ২৯ সেপ্টেম্বর শুরু হয়েছিল। এর ফলে পাকিস্তান-শাসিত কাশ্মীরের বেশ কয়েকটি জেলা কার্যত স্থবির হয়ে পড়েছে।
পাকিস্তান সরকার তাদের পক্ষ থেকে অঞ্চলটিতে ২৮ সেপ্টেম্বর থেকে বাসিন্দাদের মোবাইল টেলিযোগাযোগ এবং ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়।
বর্তমানে থমথমে মুজাফ্ফরাবাদে ব্যস্ত বাজারগুলো বন্ধ রয়েছে। রাস্তায় বিক্রেতা কিংবা কোনো গণপরিবহন দেখা যাচ্ছে না। এই অচলাবস্থার কারণে অঞ্চলটির ৪০ লাখের বেশি বাসিন্দা অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে।
সরকার এক বিবৃতিতে বলেছে, কর্তৃপক্ষ শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার জন্য কাজ করছে। জনসাধারণকে ‘নির্দিষ্ট এজেন্ডার’ অংশ হিসেবে সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচারিত প্রচারণা এবং ‘ভুয়া খবর’ থেকে প্রভাবিত না হওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে।
জেএএসি-এর নেতৃত্বে এই বিক্ষোভটি গত দুই বছরের মধ্যে বড় ধরনের তৃতীয় সমাবেশ। সংগঠনের নেতাদের মতে, সরকার কমিটির ৩৮ দফা দাবিতে একমত হতে ব্যর্থ হওয়ার পর এটি শুরু হয়।
বর্তমান সংকটটি পাকিস্তান-শাসিত কাশ্মীরের স্থানীয় সরকার এবং তৃণমূল পর্যায়ের একটি আন্দোলনের মধ্যে দুই বছরের সংঘর্ষের সর্বশেষ উত্থানের লক্ষণ। তারা ইতোমধ্যে বেশ কয়েকবার রাজপথের শক্তি প্রদর্শন করেছে।
বিক্ষোভের কারণ কী?
কাশ্মীর উপত্যকা একটি মনোরম, কিন্তু গভীরভাবে বিতর্কিত হিমালয় অঞ্চল। এটি নিয়ে ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন থেকে স্বাধীনতা লাভের পর থেকে পাকিস্তান এবং ভারত একাধিক যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে। উভয় দেশই এর কিছু অংশ নিয়ন্ত্রণ করে, চীনও এই অঞ্চলের উত্তরের দুটি অংশ শাসন করে।
ভারত এই অঞ্চলের সম্পূর্ণ অংশ দাবি করে। অন্যদিকে, পাকিস্তান তার মিত্র চীনের দখলে থাকা অংশ ছাড়া পুরো কাশ্মীর দাবি করে।
পাকিস্তান-শাসিত কাশ্মীর একটি আধা-স্বায়ত্তশাসিত ব্যবস্থার অধীনে পরিচালিত হয়। সেখানে নিজস্ব প্রধানমন্ত্রী এবং আইনসভা রয়েছে।
বর্তমান অস্থিরতার সূত্রপাত ২০২৩ সালের মে মাসে – যখন বাসিন্দারা প্রথমবারের মতো আকাশছোঁয়া বিদ্যুৎ বিলের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে রাস্তায় নেমে আসে। একই সঙ্গে ব্যাপক আটা চোরাচালান এবং ভর্তুকিযুক্ত গমের সরবরাহে তীব্র ঘাটতির অভিযোগ ওঠে।
২০২৩ সালের আগস্টের মধ্যে এই ভিন্ন ভিন্ন অভিযোগগুলো সংগঠিত প্রতিরোধে মিলিত হয়েছিল। সেই বছরের সেপ্টেম্বরে শত শত কর্মী আনুষ্ঠানিকভাবে জেএএসি প্রতিষ্ঠার জন্য মুজাফফরাবাদে জড়ো হন। তারা এই অঞ্চলের সমস্ত জেলার প্রতিনিধিদের একত্রিত করেন।
২০২৪ সালের মে মাসে আন্দোলনটি প্রথম বড় ধরনের উত্তেজনায় পৌঁছে। বিক্ষোভকারীরা মুজাফফরাবাদের দিকে একটি লং মার্চ শুরু করে। ফলে সহিংস সংঘর্ষ শুরু হয় এবং একজন পুলিশ অফিসারসহ কমপক্ষে পাঁচ জন নিহত হয়।
পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরীফ আটার দাম কমানো এবং বিদ্যুতের শুল্ক কমানোর মূল দাবিতে সম্মত হওয়ার পর সেই সহিংস বিক্ষোভ স্থগিত করা হয়। সরকার আটা সাশ্রয়ী মূল্যের করতে এবং বিদ্যুতের দাম কমানোর জন্য কোটি কোটি টাকা ভর্তুকি বরাদ্দ করে।
তবে সেই শান্তি ক্ষণস্থায়ী প্রমাণিত হয়েছে। এই বছরের আগস্টে জেএএসি ঘোষণা করে, তারা আরও একটি ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ করবে। এবার অর্থনৈতিক অভিযোগের বাইরেও সমালোচনা আরও বিস্তৃত করা হবে।
জেএএসি উপস্থাপিত সর্বশেষ দাবির সনদে ৩৮টি সুস্পষ্ট দফা রয়েছে। দাবিগুলোর মধ্যে রয়েছে, বিনামূল্যে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা প্রদান এবং বড় বড় অবকাঠামো প্রকল্প চালু করা থেকে শুরু করে প্রাদেশিক আইনসভার কাঠামো পরিবর্তন করা। কর ছাড় এবং উন্নত কর্মসংস্থানের সুযোগও এতে অন্তর্ভুক্ত।
জেএএসি’র দৃষ্টিভঙ্গিতে অবকাঠামোগত উন্নয়ন গুরুত্বপূর্ণ। কমিটি একটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ছাড়াও পাহাড়ি অঞ্চলকে পাকিস্তানের বাকি অংশের সঙ্গে সংযুক্ত করার জন্য টানেল এবং সেতুসহ নতুন প্রকল্পের দাবি জানিয়েছে।
মুজাফফরাবাদে বর্তমানে একটি বিমানবন্দর রয়েছে, এটি বছরের পর বছর ধরে অকার্যকর অবস্থায় রয়েছে। তবে এই বছরের এপ্রিলে প্রধানমন্ত্রী শরীফ প্রকল্পটি পুনরুজ্জীবিত করার জন্য একটি কমিটি গঠন করেন। তিনি এই অঞ্চলের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর মিরপুরে আরেকটি বিমানবন্দরের উন্নয়নের সম্ভাব্যতা পরীক্ষা করার জন্যও নির্দেশনা জারি করেন।
বিক্ষোভের পর সরকার কীভাবে সাড়া দিচ্ছে
স্থানীয় প্রশাসন যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ রাখার নির্দেশ দিয়েছে। তারা পাকিস্তানের বাকি অংশ থেকে আধাসামরিক বাহিনী এবং অতিরিক্ত পুলিশ বাহিনী মোতায়েন করতে কেন্দ্রীয় সরকারকে আহ্বান জানিয়েছে।
পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার বলছে, সংঘর্ষে এখন পর্যন্ত নয় জন নিহত হয়েছে। তবে স্থানীয় সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বলেছেন, মৃতের সংখ্যা ১৫ জন।
জেএএসি আধাসামরিক বাহিনী মোতায়েনের বিরোধিতা করেছে। সংগঠনের নেতা মীর এই সপ্তাহের শুরুতে সাংবাদিকদের বলেছিলেন, স্থানীয় পুলিশ ইতোমধ্যেই উপস্থিত থাকায় পাকিস্তানের মূল ভূখণ্ড থেকে আধাসামরিক বাহিনী পাঠানোর কোনো প্রয়োজন ছিল না।
পাকিস্তান-শাসিত কাশ্মীরের অর্থমন্ত্রী আব্দুল মজিদ খান স্বীকার করেছেন, ইতোমধ্যেই প্রথম দফার আলোচনা হয়ে গেছে, এখন একটি নতুন কমিটি মুজাফফরাবাদে এসেছে। তাদের বিশেষভাবে বিক্ষোভকারীদের অভিযোগ সমাধানের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
তিনি কেন্দ্রীয় সরকারকে সমর্থন করে বলেন, ‘প্রাথমিকভাবে যখন তারা গত বছর তাদের প্রতিবাদ শুরু করেছিল, তখন এটি সম্পূর্ণ বিদ্যুৎ এবং আটার দাম নিয়ে ছিল। আমরা এগুলোতে একমত হয়েছিলাম। তবে তাদের এটাও বুঝতে হবে যে, সবকিছু রাতারাতি সবকিছু ঘটতে পারে না, এতে সময় লাগে।’
তবে মজিদ খান খান স্বীকার করেছেন, সরকার জেএএসি-এর ৩৮টি দফার বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই একমত হলেও, দুটি বিশেষ বিতর্কিত বিষয়ে আলোচনা অচলাবস্থায় পৌঁছেছে। এর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণটি হলো, শরণার্থীদের জন্য ১২টি সংরক্ষিত আসন বাতিল করা।
এরপর কি হবে?
বৃহস্পতিবার সরকারি প্রতিনিধি এবং জেএএসি সদস্যদের মধ্যে আলোচনা কোনো সমাধান ছাড়াই শেষ হয়েছে। পরবর্তী দফা আলোচনা আজ শুক্রবার হওয়ার কথা।
উভয় পক্ষই প্রকাশ্যে সংলাপের প্রতি তাদের প্রতিশ্রুতি প্রকাশ করেছে। কিন্তু বারবার প্রতিশ্রুতি এবং হতাশার চক্রের পরে ‘অবিশ্বাস’ গভীর হয়েছে।
জেএএসি’র অব্যাহত বিক্ষোভ সত্ত্বেও সরকার বলেছে, তারা বেশিরভাগ দাবি পূরণ করেছে। সাংবিধানিক ও নির্বাচনী সংস্কারের জন্য আইন প্রণয়ন প্রক্রিয়া প্রয়োজন, যা রাতারাতি সম্ভব নয়।
মজিদ খান ইঙ্গিত দিয়েছেন, আলোচনায় অর্থবহ অগ্রগতি হলে সরকার ইন্টারনেট এবং মোবাইল পরিষেবা পুনরুদ্ধারের জন্য দ্রুত পদক্ষেপ নেবে। তিনি বলেন, আলোচনাকারী দল মুজাফফরাবাদে উপস্থিত থাকায় আমি নিশ্চিত যে, এই অচলাবস্থার একটি সমাধান হবে এবং শিগগিরই পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে যাবে।’
তথ্যসূত্র: আল জাজিরা