
পদ নেই, তবু প্রশাসনে পদোন্নতি দেওয়ার প্রবণতা চলছে গত দেড় দশক ধরে। বর্তমানে প্রশাসনে পদের চেয়ে কর্মকর্তা বেশি সহস্রাধিক। অতিরিক্ত সচিব, যুগ্মসচিব ও উপসচিদের পদ সংখ্যা (প্রেষণসহ) ১ হাজার ৮৩৯টি। অথচ এসব পদের বিপরীতে কর্মকর্তা রয়েছেন ২ হাজার ৯৬৬ জন।
পদোন্নতিপ্রাপ্তদের বেতন-ভাতা ও মর্যাদা বাড়লেও অনেকে পদ খালি না থাকায় আগের কাজই করছেন। অন্তর্বর্তী সরকারের গত এক বছরের বেশি সময়ে প্রশাসনে পদোন্নতি পেয়েছেন ১ হাজার ৮১৭ জন কর্মকর্তা। এর মধ্যে সিনিয়র সহকারী সচিব থেকে সিনিয়র সচিব পর্যন্ত নিয়মিত পদোন্নতি পেয়েছেন ৭৮৫ জন। অন্য দিকে ৭৬৪ জন আওয়ামী আমলে বঞ্চিত বিএনপি-জামায়াতসমর্থিত কর্মকর্তা ভূতাপেক্ষ পদোন্নতি পেয়েছেন। গত ২৮ আগস্ট উপসচিব পদে ২৬৮ জনকে পদোন্নতি দেওয়া হয়। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর সামনে আসেন প্রশাসনে বিএনপি-জামায়াত ঘরানার বঞ্চিত কর্মকর্তারা। পরদিন ৬ আগস্ট সচিবালয়ে বৈঠক করেন পদোন্নতিবঞ্চিত কর্মকর্তারা। সভায় জ্যেষ্ঠতাসহ ভূতাপেক্ষ পদোন্নতির দাবি জানান তারা। এরপর তারা প্রশাসনে কর্মরত বঞ্চিত কর্মকর্তাদের ব্যাচভিত্তিক তালিকা তৈরি করে পদোন্নতির জন্য সচিবের দপ্তরে জমা দেন। ঐ সময় আগে অবসরে যাওয়া ৭৬৪ জন কর্মকর্তাকে সচিব পদসহ বিভিন্ন পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়। তারা আর্থিক সুবিধা ও মর্যাদা পেয়েছেন। তবে জনপ্রশাসন তাদের কোনো কাজে লাগাতে পারেনি। সম্প্রতি অন্যান্য ক্যাডারের ‘বঞ্চিত’ ৭৮ জন অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে ভূতাপেক্ষ পদোন্নতির সুপারিশ করেছে পর্যালোচনা কমিটি।
সংশ্লিষ্টরা বলেন, প্রশাসনিক কাঠামোর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এসব পদে পদোন্নতি পাওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই কর্মকর্তারা খুশি। কিন্তু এই খুশির মধ্যেও আরেকটি বাস্তবতা সামনে চলে এসেছে। সেটি হচ্ছে, পদোন্নতি হলেও বেশির ভাগ কর্মকর্তাকেই কাজ করতে হচ্ছে আগের পদেই। অর্থাত্ যে কাজ করে আসছিলেন, এখনো সে কাজই করতে হবে। কেননা এই পদোন্নতির ফলে নিয়মিত পদের চেয়ে কর্মকর্তার সংখ্যা বেশি হয়ে গেছে। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে পদোন্নতিবঞ্চিত পাঁচ জন কর্মকর্তা বলেন, আমরা গত ১৬ বছর বঞ্চনার শিকার ছিলাম। শুধু রাজনৈতিক কারণে আওয়ামী শাসনামলের আমরা পদোন্নতিবঞ্চিত ছিলাম। এক-দুই জন নয়, কয়েক শত কর্মকর্তা। তারা বলেন, বিশেষ উদ্দেশ্যে গোয়েন্দা তদন্ত প্রতিবেদনে আমাদের নামের সঙ্গে ‘নেগেটিভ’ উল্লেখ করে দেওয়া হয়েছিল। অনেককে বছরের পর বছর ওএসডি থাকতে হয়েছে অথবা গুরুত্বহীন পদে ফেলে রাখা হয়েছিল। অনেককে বাধ্যতামূলক অবসরেও পাঠানো হয়।
জানা গেছে, এ মুহূর্তে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে সচিব নেই। বর্তমানে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে আছেন অতিরিক্ত সচিব ড. আবু শাহীন মো. আসাদুজ্জামান। গত ২১ সেপ্টেম্বর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. মো. মোখলেস উর রহমানকে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য হিসেবে বদলি করা হয়েছে। ২৮ আগস্ট জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন। ঐ সময় তাকে দুই বছরের জন্য চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। এদিকে নতুন সচিব নিয়োগ না হওয়া পর্যন্ত পদটি খালি থাকবে, যার ফলে পদোন্নতির কার্যক্রমও আপাতত থেমে আছে। গত ২০ মার্চ সরকার প্রশাসনের ১৯৬ জন কর্মকর্তাকে যুগ্মসচিব পদে পদোন্নতি দেয়। এর মধ্যে ২৪তম ব্যাচের পদোন্নতিযোগ্য ৩২০ জনের মধ্যে পদোন্নতি পেয়েছিলেন ১৩৭ জন। আর বাদ পড়েন ১৮৩ জন। এরপর বঞ্চিতরা দলবেঁধে মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিবের সঙ্গে দেখা করে পদোন্নতির বিষয়টি পুনর্বিবেচনার আবেদন করেন। তবে সচিব না থাকায় পদোন্নতিসংক্রান্ত সর্বোচ্চ ফোরাম সুপিরিয়র সিলেকশন বোর্ড (এসএসবি) হচ্ছে না। এ কারণে পদোন্নতি দেওয়া আপাতত বন্ধ রয়েছে। অপরদিকে গত এক বছরে অন্তত ৯ জন সচিব ও ১৯ জন অতিরিক্ত সচিবকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে। ৮৭ জনকে ওএসডি করা হয়েছে। তাদের মধ্যে অনেকে দুর্নীতিগ্রস্ত ও ক্ষমতার অপব্যবহারকারী হিসেবে পরিচিত।
মন্ত্রিপরিষদ সচিবকে সভাপতি করে গঠিত সুপিরিয়র সিলেকশন বোর্ড (এসএসবি) প্রশাসনে উপসচিব ও তার ওপরের পদে পদোন্নতির জন্য কর্মকর্তা বাছাই করে। এই কমিটিতে আছেন অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ, জ্বালানি উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান, পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, তথ্য উপদেষ্টা মাহফুজ আলম, মন্ত্রিপরিষদ সচিব শেখ আব্দুর রশিদ এবং জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব মো. মোখলেস উর রহমান। কমিটির সিদ্ধান্ত প্রধান উপদেষ্টার কাছে অনুমোদনের জন্য পাঠানো হয়। এরপর পদোন্নতি-পদায়নের সিদ্ধান্ত হয়। বর্তমানে সচিব পদের ১০ কর্মকর্তা ওএসডি (প্রশাসনিক) রয়েছেন। একই পদে ১২ জন রয়েছেন চুক্তি ভিত্তিতে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুযায়ী, বর্তমানে সহকারী সচিব থেকে সচিব পর্যন্ত প্রশাসনে মোট কর্মকর্তা আছেন ৬ হাজার ৫১৮ জন। এর মধ্যে সিনিয়র সচিব, সচিব বা সমপর্যায়ের কর্মকর্তা আছেন ৮৪ জন এবং গ্রেড-১ পদের কর্মকর্তা আছেন ১৫ জন। এই পদে নির্দিষ্ট পদসংখ্যা নেই। অতিরিক্ত সচিবের নিয়মিত পদ আছে ২১২টি। এর সঙ্গে বিভিন্ন দপ্তরে প্রেষণে থাকা প্রায় ১২৫টি পদ মিলে মোট পদ দাঁড়ায় ৩৩৭টি। অথচ অতিরিক্ত সচিব আছেন ৩৪৩ জন। অন্যদিকে যুগ্মসচিবের পদ রয়েছে ৫০২টি। কিন্তু কর্মকর্তা আছেন ১ হাজার ২৭ জন। এদিকে জনপ্রশাসনে এখন নিয়মিত উপসচিবের ১ হাজার পদের বিপরীতে কর্মকর্তা রয়েছেন ১ হাজার ৫৯৬ জন। পদের চেয়ে কর্মকর্তার সংখ্যা বেশি থাকার মধ্যে গত ২৮ আগস্ট ২৬৮ জনকে উপসচিব পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়। সিনিয়র সহকারী সচিব আছেন ১ হাজার ৮৭৩ জন এবং সহকারী সচিবের সংখ্যা ১ হাজার ৫৩৩। এ ক্ষেত্রে নিয়মিত কোনো নির্দিষ্ট পদসংখ্যা নেই।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা তুলনামূলকভাবে সবচেয়ে বেশি সুবিধাপ্রাপ্ত হিসেবে চিহ্নিত। রাজস্ব ক্যাডারের এক জন কর্মকর্তা জানান, বদলির আদেশ ছিঁড়ে ফেলার কারণে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের অন্তত ২০ জন কর্মকর্তাকে জোরপূর্বক অবসরে পাঠানো হয়েছে অথবা অন্য শাস্তি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে হাতাহাতির ঘটনায় জড়িত প্রশাসন ক্যাডারের ১৫ জন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে তদন্তে সত্যতা মিললেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। তাদের কয়েক জনকে বরং উপসচিব থেকে যুগ্মসচিব পদে উন্নীত করা হয়েছে। তিনি বলেন, ‘কোনো একটি ক্যাডারের কর্মকর্তারা সচিবালয়ে মারামারি বা দুর্নীতি যা-ই করুন তাদের কিছুই হয় না, বরং ভালো ভালো পদায়ন ও পদোন্নতি পান? আমরা কীভাবে এই প্রশাসনের প্রতি আস্থা রাখব?’ একই প্রশ্ন তোলেন শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও তথ্য ক্যাডারের কর্মকর্তারাও। অভিযোগ আছে, প্রশাসন, পুলিশ ও পররাষ্ট্র ক্যাডারে দ্রুত পদোন্নতি হয়। অন্য ক্যাডারে বছরের পর বছর কর্মকর্তারা পদোন্নতির আশায় বসে থাকেন।