
মিরপুর শের-ই-বাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়ামের আলো-ঝলমলে প্রাঙ্গণে গেল পরশু এক বিদায়ী সুর বেজেছে। বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) বর্তমান পরিচালনা পর্ষদের শেষ সভা ছিল সেটি। রাত ৯টায় শুরু হয়ে প্রায় দুই ঘণ্টারও বেশি সময় চলা ঐ সভা শুরু হওয়ার কথা ছিল সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায়। কিন্তু আদালতের একটি সিদ্ধান্তের কারণে এই কালক্ষেপণ হয়েছে বলে জানিয়েছেন বিসিবি পরিচালক ও মিডিয়া কমিটির সভাপতি ইফতেখার রহমান মিঠু এবং বিসিবির আইনজীবী মাহিন রহমান।
এ দিকে সভায় বিদায়ের আবহ ছড়িয়ে পড়লেও কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তও এসেছে সামনে। তফসিল অনুযায়ী, গেল পরশু সন্ধ্যা ৬টার মধ্যেই শেষ হওয়ার কথা ছিল কাউন্সিলরদের মনোনয়ন জমা দেওয়ার সময়সীমা। এরপর সন্ধ্যা ৭টায় প্রকাশ হওয়ার কথা ছিল খসড়া ভোটার তালিকা। কিন্তু বাস্তবে বোর্ড সভা বসে রাত ৯টায় এবং তখনো নির্ধারিত সময় শেষ হওয়ার পরেও আসছিল নতুন নাম। সময় পেরিয়ে রেঞ্জার্স ক্রিকেট একাডেমি থেকে সাবেক সভাপতি ফারুক আহমেদের নামও জমা পড়ে।
সভা শেষে সংবাদ সম্মেলনে বিসিবির মিডিয়া কমিটির প্রধান ইফতেখার রহমান মিঠু জানিয়েছেন, দেরিতে আসা এসব ফরম ‘নোট’ করে গ্রহণ করা হয়েছে। তবে এগুলো গ্রহণ বা বাতিলের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে নির্বাচন কমিশন। তাদের হাতেই খসড়া ভোটার তালিকা প্রকাশের দায়িত্ব। পরে সব জটিলতা শেষ করে গতকাল সন্ধ্যায় তিন ক্যাটাগরিতে ভাগ করে ১৭৭ জনের নাম দিয়ে ভোটারদের খসড়া একটি তালিকা প্রকাশ করে বিসিবি।
সব কিছু ঠিক থাকলে নির্ধারিত সূচি অনুযায়ী নির্বাচন হওয়ার কথা ৬ অক্টোবর। আর গতকাল ভোটার তালিকা প্রকাশ হওয়ার পরপরই শুরু হয়ে গেছে বিসিবির আসন্ন নির্বাচনের দামামা বাজা। আজ হবে খসড়া ভোটার তালিকার ওপর আপত্তি গ্রহণ। সকাল ১০ টা থেকে বিকেল ৫ টা পর্যন্ত বিসিবি নির্বাচনের প্রধান কমিশনারের কার্যালয়ে এই আপত্তি জানানো যাবে। তারপর আগামীকাল হবে আপত্তির উপর শুনানী। পরবর্তীতে শুক্রবার এসব ঝামেলা চুকিয়ে হবে চূড়ান্ত ভোটার তালিকা প্রকাশ। আর শনিবার থেকে হবে নির্বাচনের মনোনয়নপত্র বিতরণ শুরু। সব মিলিয়ে নির্বাচনের আগে এই কয়দিন ব্যস্তই থাকবে হোম অব ক্রিকেট খ্যাত মিরপুর শের-ই-বাংলা স্টেডিয়াম।
সোমবারই প্রকাশ হত ভোটারদের খসড়া তালিকা। তবে ঐদিন আদালতে দুটি রিট দায়ের হওয়ার কারণেই বোর্ড ভোটার তালিকা প্রকাশে পিছিয়ে যায়। মিঠু জানিয়েছেন, আদালতের নির্দেশনা ভালোভাবে বুঝে তারপরই সভায় বসা হয়। বিসিবির আইনজীবী মাহিন রহমান জানিয়েছেন, ২৮ সেপ্টেম্বর চেম্বার জজ আদালতে আবারও শুনানি হবে।
এরই মধ্যে জেলা ও বিভাগ থেকে কাউন্সিলর মনোনয়ন নিয়ে শুরু হয়েছে তীব্র বিতর্ক। এই বিতর্কের সূত্রপাত হয় ১৮ সেপ্টেম্বর বিসিবি সভাপতি আমিনুল ইসলাম বুলবুলের পাঠানো এক চিঠি থেকে। যদিও মনোনয়ন জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ছিল ১৭ সেপ্টেম্বর, সভাপতির চিঠির পর দুই দফায় সময় বাড়ানো হয়। প্রথমে ১৯ সেপ্টেম্বর এবং পরে চূড়ান্তভাবে ২২ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত। সেই চিঠিতে বলা হয়েছিল, জেলা ও বিভাগীয় ক্রীড়া সংস্থার অ্যাডহক কমিটির সদস্যদের মধ্য থেকেই কাউন্সিলর মনোনীত করতে হবে। কিন্তু নিয়মটি সঠিকভাবে মানা হয়নি বলেই নতুন ফরম পাঠানো হয়।
সময় বাড়ানো নিয়েও তৈরি হয় দ্বন্দ্ব। ইফতেখার রহমান মিঠু জানান, সভাপতির একক সিদ্ধান্তেই ২২ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময় বাড়ানো হয়েছে। তবে তার পাশেই থাকা বিসিবির আইনজীবী মাহিন রহমান বলেন, ২০ সেপ্টেম্বরের সভায় সর্বসম্মতিক্রমেই সময় বাড়ানো হয়। অর্থাৎ একই বিষয়ে দুই ভিন্ন ব্যাখ্যা উঠে এসেছে বোর্ড কর্তাদের কাছ থেকে। কাউন্সিলর বিতর্ক ছাড়াও ছিল আরেকটি বড় ঘোষণা। দীর্ঘদিনের অনিশ্চয়তা কাটিয়ে বিপিএলের ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি হিসেবে নির্বাচিত হয়েছে আইএমজি। তিন বছরের জন্য দায়িত্ব দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হলেও এখনো আনুষ্ঠানিক চুক্তি স্বাক্ষর হয়নি। ডিসেম্বর-জানুয়ারিতে বিপিএলের পরবর্তী আসর আয়োজনের লক্ষ্য ঠিক করেছে বিসিবি, যদিও শেষ পর্যন্ত আয়োজনের ভার নতুন বোর্ডের কাঁধেই পড়বে।
এদিকে বিসিবি জানিয়েছে, বিপিএলের পুরোনো ফ্যাঞ্চাইজিগুলোর কাছে এখনো প্রায় ৪০ কোটি টাকার বকেয়া পড়ে আছে। খেলাপকারীর তালিকা তুলে ধরা হয় সংবাদ সম্মেলনে। এর মধ্যে রয়েছে বরিশাল বার্নার্স, চিটাগং কিংস, ঢাকা প্ল্যাডিয়েটর্স, খুলনা রয়্যাল বেঙ্গল, দুরন্ত রাজশাহী, সিলেট রয়্যালস, সিলেট সুপারস্টার, বরিশাল বুলস, সিলেট সিক্সার্স, রাজশাহী কিংস, রাজশাহী রয়্যালস, সিলেট থান্ডার্স, চট্টগ্রাম চ্যালেঞ্জার্স, সিলেট সানরাইজার্স, ঢাকা ডমিনেটর্স, দূরন্ত ঢাকা, দুর্বার রাজশাহী এবং ডেল্টা স্পোর্টসসহ মোট ১৮টি দল। এদের সঙ্গেই এখনো সালিশ প্রক্রিয়া চলছে।
এছাড়া ক্লাব মালিকানা বিতর্ক নিয়েও সিদ্ধান্ত এসেছে। ঢাকা স্পার্টান্স, ব্রুজ ক্রিকেটার্স, ঢাকা রেঞ্জার্স ও গোল্ডেন ঈগল-এই চার ক্লাবের মালিকানা শেষ পর্যন্ত তাদেরই হাতে দেওয়া হয়েছে, যারা সর্বশেষ মৌসুমে দলগুলো পরিচালনা করেছেন। সবচেয়ে আলোচনার বিষয় ছিল অর্থনৈতিক শক্তি। বর্তমান বোর্ডের মেয়াদ শেষ হওয়ার প্রাক্কালে পরিচালক ইফতেখার রহমান মিঠু জানান, বিসিবি প্রায় ১ হাজার ৩৯৮ কোটি টাকা রেখে যাচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে ব্যাংক নগদ, হাতে নগদ এবং বিভিন্ন এফডিআর। অর্থাৎ দেশীয় ক্রীড়াঙ্গনের সবচেয়ে ধনী সংগঠন বিসিবি এখন বিশ্ব ক্রিকেটেও অর্থনৈতিকভাবে বলিষ্ঠ অবস্থান দখল করে আছে।
সর্বোপরি, একদিকে নির্বাচনকে ঘিরে আদালতের রিট, ভোটার তালিকা নিয়ে বিতর্ক, সময়সীমার দোলাচল-সবমিলে বিসিবির প্রশাসনিক অঙ্গনে এখনো অস্থিরতা বিরাজ করছে। অন্যদিকে বিপিএল আয়োজনের রূপরেখা ও অর্থনৈতিক শক্তির প্রদর্শনী ইঙ্গিত করছে, নতুন নেতৃত্ব এলেও সামনে অপেক্ষা করছে বড় চ্যালেঞ্জ ও নতুন বাস্তবতা।