
ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রার কারণে বাংলাদেশ গুরুতর স্বাস্থ্যঝুঁকি এবং অর্থনৈতিক ক্ষতির মুখে পড়ছে বলে সতর্ক করেছে বিশ্বব্যাংক। সংস্থাটির জরিপ অনুযায়ী ২০২৪ সালে এক বছরে তাপ-সংশ্লিষ্ট অসুস্থতার কারণে প্রায় আড়াই কোটি কর্মদিবস নষ্ট হয়েছে। যার আর্থিক মূল্য ১৩৩ কোটি থেকে ১৭৮ কোটি ডলার। যা স্থানীয় মুদ্রায় প্রায় ১৫ হাজার ৯৬০ কোটি থেকে ২১ হাজার ৩৬০ কোটি টাকার সমান। এই হিসাব ঐ বছরের মোট জিডিপির শূন্য দশমিক ৩ শতাংশ থেকে শূন্য দশমিক ৪ শতাংশের সমান। এছাড়া গ্রীষ্মকালে তাপমাত্রা যখন ৩৭ ডিগ্রি ছাড়িয়ে যায় সে সময় শ্রমজীবী মানুষের উৎপাদনশীলতা উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যায়। গতকাল মঙ্গলবার সংস্থাটি প্রকাশিত ‘অ্যান আনসাস্টেইনেবল লাইফ : দ্য ইমপ্যাক্ট অব হিট অন হেলথ অ্যান্ড দ্য ইকোনমি অব বাংলাদেশ’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে আসে। প্রতিবেদনে বলা হয়, ১৯৮০ সাল থেকে বাংলাদেশের গড় তাপমাত্রা বেড়েছে ১.১ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং ‘অনুভূত’ তাপমাত্রা বেড়েছে ৪.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এ কারণে ডায়রিয়া, দীর্ঘস্থায়ী কাশি, শ্বাসতন্ত্রের রোগ, ক্লান্তিজনিত অসুস্থতা, মানসিক সমস্যা যেমন বিষণ্ণতা ও উদ্বেগের হার বাড়ছে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, গ্রীষ্মকালে ডায়রিয়া ও দীর্ঘস্থায়ী কাশির হার শীতকালের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ। নারীরা হিট স্ট্রোক ও ক্লান্তিজনিত অসুস্থতায় বেশি ঝুঁকিতে রয়েছেন। তীব্র গরমের কারণে শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা বাড়ায় উৎপাদনশীলতার ক্ষতিও বেড়েছে।
বিশ্বব্যাংক বলেছে, তাপপ্রবাহ এখন কেবল মৌসুমি অস্বস্তি নয়, বরং সুদূরপ্রসারী হুমকি। এ পরিস্থিতি মোকাবিলায় জরুরি ও সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানানো হয়েছে।
গতকাল রাজধানীর একটি হোটেলে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিবেদন প্রকাশ করে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিস।
প্রকাশনা অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। বিশেষ অতিথি ছিলেন প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী (স্বাস্থ্য) ডা. মো. সায়েদুর রহমান। বিশ্বব্যাংকের ডিভিশনাল ডিরেক্টর জেন পেসমির সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন বিশ্বব্যাংকের সিনিয়র অপারেশন অফিসার ইফফাত মাহমুদ এবং হেলথ স্পেশালিষ্ট ওমিকিউ এ রাজা। প্রতিবেদনে ১৯৭৬ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত জাতীয় তাপমাত্রা ও আর্দ্রতার ধারা বিশ্লেষণ করা হয়েছে। পাশাপাশি ২০২৪ সালে ১৬ হাজারেরও বেশি মানুষের ওপর পরিচালিত জরিপের ভিত্তিতে প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে।
এতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে ২০০৮ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত সারা দেশে গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে ১ দশমিক ১ ডিগ্রি। তবে ঢাকায় সেটি আরও বেড়ে দাঁড়ায় ১ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, তাপমাত্রা বৃদ্ধির ঝুঁকিতে বাংলাদেশ বিশ্বের মধ্যে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে। জাতীয় গড় তাপমাত্রার তুলনায় ঢাকার হিট ইনডেক্স প্রায় ৬৫ শতাংশ বেশি। এর অর্থনৈতিক ক্ষতিও ব্যাপক।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, তাপ বৃদ্ধিজনিত কারণে সবচেয়ে বেশি হচ্ছে দীর্ঘমেয়াদি কাশিজনিত সমস্যা। শীতকালে যেখানে এমন কাশিতে আক্রান্তের হার ৩ দশমিক ৩ শতাংশ, গ্রীষ্মকালে সেটি বেড়ে হয় ৬ শতাংশ। এছাড়া জরিপে অংশ নেওয়া ২ দশমিক ৬ শতাংশ মানুষ মনে করে তাপজনিত কারণে তারা ক্লান্ত ছিলেন। ৩৬ থেকে ৬৫ বছর বয়সী কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর মানুষের ক্লান্তি সবচেয়ে বেশি। তবে ৬৬ বছর বয়সী মানুষের তাপজনিত ক্লান্তি সবচেয়ে বেশি।
এছাড়া ডায়রিয়া রোগের হার ঋতুভেদে ব্যাপক পরিবর্তিত হয়। গ্রীষ্মকালে ডায়রিয়া আক্রান্ত হওয়ার হার ৪ দশমিক ৪ শতাংশ। শীতকালে এই হার থাকে ১ দশমিক ৮ শতাংশ। এই রোগে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয় নারী ও পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুরা। এছাড়া তাপ বৃদ্ধি মানসিক সমস্যাও তৈরি করে। শীতে যেখানে বিষণ্ণতায় ভোগার হার ১৬ দশমিক ২ শতাংশ, সেখানে গ্রীষ্মে বেড়ে দাঁড়ায় ২০ শতাংশে।
প্রতিবেদনে দেওয়া সুপারিশে বলা হয়েছে, তাপপ্রবাহ আরও ভালোভাবে মোকাবিলার জন্য জাতীয় প্রস্তুতির সক্ষমতা বাড়াতে হবে। সেটি করতে হবে বহুপাক্ষিক সমন্বিত পদক্ষেপের মাধ্যমে। এছাড়া উচ্চ তাপমাত্রাজনিত স্বাস্থ্য সমস্যা প্রাণহানি রোধে শক্তিশালী পদক্ষেপ নিতে হবে। তাপের প্রবাহ থেকে স্বাস্থ্য রক্ষায় উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার করতে হবে। কার্যকর সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য সঠিক ও বিস্তারিত আবহাওয়ার তথ্য সংগ্রহ করতে হবে। বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির প্রভাব কমাতে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ও অর্থায়নের ব্যবস্থা করতে হবে।
মন্ত্রী-এমপিদের প্লট দিতে গিয়ে রাজউক যা ক্ষতি করার করেছে :উপদেষ্টা রিজওয়ানা
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, মন্ত্রী-এমপিদের প্লট দিতে গিয়ে রাজউক যা ক্ষতি করার করেছে। এখন এসব বন্ধ করে ক্ষতি পোষানোর উদ্যোগ নিতে হবে। সবুজ ধ্বংস করে রাজউকের আবাসিক প্রকল্প করা যাবে না। সেই সঙ্গে ঢাকা থেকে মাওয়া পর্যন্ত গেলে দেখা যায় ধান ক্ষেতে হাজার হাজার আবাসন প্রকল্পের সাইনবোর্ড। এগুলো কেন বন্ধ করা যাচ্ছে না, তা ভেবে দেখতে হবে। সঠিকভাবে ড্যাপ তৈরি এবং বাস্তবায়ন করতে হবে। ঢাকাকে ব্যবসায়ীদের হাতে তুলে না দিয়ে নগরবাসীর হাতে দিতে হবে। জনগণেরও দায়বদ্ধতা আছে। আইন মানতে হবে। সেই সঙ্গে ঢাকাকে বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী (স্বাস্থ্য) ডা. মো. সায়েদুর রহমান বলেন, তাপমাত্রাজনিত স্বাস্থ্য ক্ষতি কমাতে আন্তর্জাতিক সহায়তার প্রয়োজন। সেই সঙ্গে অভ্যন্তরীণ উদ্যোগ থাকতে হবে।
ইফফাত মাহমুদ বলেন, আমাদের বিশ্লেষণে দেখা গেছে, তাপের প্রভাবে স্বাস্থ্যের অবনতি এবং উৎপাদনশীলতার বড় ক্ষতি হচ্ছে। বাংলাদেশও মানবসম্পদ ও উৎপাদনশীলতা হারানোর ঝুঁকিতে রয়েছে। তিনি আরও বলেন, প্রমাণভিত্তিক নীতি ও টার্গেট বিনিয়োগের মাধ্যমে অভিযোজন সক্ষমতা বাড়ানো গেলে মানুষের জীবনমান ও জীবিকা রক্ষা পাবে এবং ভবিষ্যৎ সুস্থ ও নিরাপদ হবে।