
নেপালের প্রধানমন্ত্রী কে পি শর্মা অলি তরুণ বিক্ষোভকারীদের ‘জেন-জি’ বলে উপহাস করার ৪৮ ঘণ্টার মধ্যেই পদত্যাগে বাধ্য হলেন। দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির বিরুদ্ধে তরুণদের আন্দোলন দমন করতে গিয়ে সহিংসতায় অন্তত ৩১ জন নিহত হওয়ার পর রাজনীতি নাটকীয় মোড় নেয়।
৮ সেপ্টেম্বর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিষেধাজ্ঞা ও সরকারের অনিয়মের বিরুদ্ধে হাজারো তরুণ রাস্তায় নামেন। সংসদ কমপ্লেক্সে ঢুকে পড়লে পুলিশ গুলি চালায়, নিহত হন অন্তত ১৯ জন। পরদিন আরও বড় বিক্ষোভে সংসদ ভবন, রাজনীতিবিদদের বাসভবন ও সংবাদমাধ্যমের কার্যালয়ে আগুন দেওয়া হয়। মঙ্গলবারই মন্ত্রিসভার সদস্যরা পদত্যাগ করেন, পরে অলি নিজেও দায়িত্ব ছাড়েন। এখন বিক্ষোভকারীরা সংসদ ভেঙে দেওয়া, অন্তর্বর্তী সরকার গঠন ও গুলির ঘটনায় জড়িতদের বিচার দাবি করছেন। রাজধানী কাঠমান্ডুতে কারফিউ চলছে, সেনা মোতায়েন করা হয়েছে।
দীর্ঘ ইতিহাসে ছাত্র আন্দোলনের ধারাবাহিকতা
নেপালের ইতিহাসে তরুণদের আন্দোলন নতুন নয়। ১৯৫১ সালে রানা শাসনের অবসান, ১৯৯০ সালে পঞ্চায়েত ব্যবস্থার পতন এবং ২০০৬ সালে রাজতন্ত্রকে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য করার পেছনেও ছাত্র-যুবকদের ভূমিকা ছিল। ২০০৮ সালে দেশটি প্রজাতন্ত্রে পরিণত হয়। এরপর ক্ষমতা মূলত তিন দল—ইউএমএল, মাওবাদী সেন্টার ও নেপালি কংগ্রেসের নেতাদের হাতে ঘুরেছে। অলি সেই ধারাবাহিকতার অংশ ছিলেন।
বিশ্লেষকদের মতে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত ছিল ক্ষোভের তাৎক্ষণিক কারণ। কিন্তু মূল চালিকা শক্তি দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও দীর্ঘদিনের শাসকদের প্রতি তরুণদের ক্ষোভ। আন্দোলনকারীরা নিজেদের ‘জেন-জি মুভমেন্ট’ বলে পরিচয় দিচ্ছেন, যা পুরোনো নেতৃত্বের প্রতি অনাস্থার প্রতিফলন।
নতুন নেতৃত্বের সন্ধান
অলি ছিলেন চতুর্থবারের মতো প্রধানমন্ত্রী। নেপালের তিন প্রধান দল—সিপিএন-ইউএমএল, সিপিএন-এমসি ও নেপালি কংগ্রেসের নেতারা গত কয়েক দশকে একে অপরের পর সরকার পরিচালনা করেছেন, যেন “মিউজিক্যাল চেয়ার” খেলা চলছে। এবার তরুণরা নতুন মুখ চাইছে। সম্ভাব্য অন্তর্বর্তী নেতৃত্বের আলোচনায় সাবেক প্রধান বিচারপতি সুশীলা কারকি ও কাঠমান্ডুর জনপ্রিয় মেয়র, র্যাপ শিল্পী বালেন্দ্র শাহের (বালেন শাহ) নাম আসছে।
আঞ্চলিক ভারসাম্য ও বৈশ্বিক দৃষ্টি
এ সংকট আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক গুরুত্বও বহন করছে। ভৌগোলিকভাবে চীন ও ভারতের মাঝে অবস্থিত নেপাল ঐতিহাসিকভাবে ভারতের ঘনিষ্ঠ হলেও অলির আমলে বেইজিংয়ের সঙ্গে সম্পর্ক গভীর হয়। তার পতনের পর কূটনৈতিক ভারসাম্যে পরিবর্তন আসতে পারে। সম্ভাব্য নতুন নেতৃত্ব হিসেবে প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি সুশীলা কার্কি ও কাঠমান্ডুর তরুণ মেয়র বালেন্দ্র শাহের নাম আলোচনায় রয়েছে।
ভারতের জন্য এই পরিবর্তন সুযোগ হয়ে উঠতে পারে। চীনের প্রভাব কমলে তারা নেপালে নিজেদের অবস্থান আরও শক্ত করবে। তবে বর্তমান তরুণ আন্দোলনের স্রোতে রাজতন্ত্রে ফেরার প্রবণতা নেই। চীনের জন্য অলির পতন ধাক্কা হলেও পাকিস্তান অপেক্ষাকৃত প্রান্তিক পর্যবেক্ষক, যদিও ঘটনাবলি ইসলামাবাদও নজরে রাখছে।
তরুণদের নতুন অধ্যায়
তরুণ প্রজন্মের ‘জেন-জি আন্দোলন’ শুধু অলি সরকারের পতনই ঘটায়নি, নেপালের রাজনীতিতে নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে। কাঠমান্ডুর অনুসন্ধানী সাংবাদিক রজনীশ ভান্ডারি বলেন, ‘এই আন্দোলন দেখায়, তরুণেরা দীর্ঘদিন ধরে শাসকদের ঔদ্ধত্য ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে ক্ষোভ পুষে রেখেছিলেন।’ নাগরিক সমাজের অনেকে বলছেন, এবার নেপালি তরুণদের কণ্ঠ উপেক্ষা করলে তা ভবিষ্যতে আরও বড় বিস্ফোরণ ডেকে আনতে পারে।
শ্রীলঙ্কা ২০২২ ও বাংলাদেশে ২০২৪ সালের মতো নেপালও দক্ষিণ এশিয়ায় তরুণদের আন্দোলনে সরকার পতনের সাক্ষী হলো। বিশ্লেষকদের মতে, এই সঙ্কট কেবল নেপালের অস্থিরতা নয়, বরং দক্ষিণ এশিয়ায় তরুণ প্রজন্মের উত্থান ও পরিবর্তনের আরেকটি অধ্যায়, যার প্রভাব ভারত-চীন প্রতিযোগিতা থেকে শুরু করে আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার ওপর পড়তে পারে।