
ভারতের কংগ্রেস নেতা শশী থারুর বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক ঘটনাবলী নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনে জামায়াতে ইসলামীর ছাত্র সংগঠনের বিজয়কে তিনি ভারতের জন্য ‘সতর্কবার্তা’ এবং বাংলাদেশের জন্য ‘রাজনৈতিক কম্পন’ হিসেবে দেখছেন। সেই সঙ্গে ভবিষ্যতে ‘ইসলামপন্থী’ দল বা জোট ক্ষমতায় আসলে নয়াদিল্লিকে ‘সজাগ থাকতে হবে’ বলে মনে করেন তিনি।
এনডিটিভিতে প্রকাশিত এক নিবন্ধে শশী থারুর বলেছেন, ডাকসু নির্বাচনে জামায়াতে ইসলামীর ছাত্র শাখা জয়লাভ করেছে, এটি একটি অত্যাশ্চর্য বিজয়। ১৯৭১ সালের পর প্রথমবারের মতো কোনো ইসলামপন্থী ছাত্র সংগঠন এই প্রভাবশালী জায়গার নিয়ন্ত্রণ অর্জন করেছে। অনেকের কাছে এটি কেবল একটি বিদেশি দেশের ছাত্র নির্বাচন। কিন্তু নয়াদিল্লির জন্য, এটি কেবল একটি বড় ধাক্কা নয় – এটি আসন্ন বিষয়গুলোর একটি উদ্বেগজনক লক্ষণ, একটি রাজনৈতিক কম্পন, যার পরবর্তী ধাক্কা শিগগিরই আমাদের সীমান্তের পাশে অনুভূত হতে পারে।
তিনি বলেন, এর তাৎপর্য বুঝতে হলে, আমাদের প্রথমে প্রেক্ষাপটটি দেখতে হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্বাচন কেবল একটি ক্যাম্পাস জরিপ নয়; এটি ঐতিহাসিকভাবে জাতির জন্য একটি রাজনৈতিক ব্যারোমিটার। জামায়াতের ছাত্র সংগঠন ছাত্র শিবিরের বিজয় দেশের দুটি ঐতিহ্যবাহী শক্তি আওয়ামী লীগ এবং বাংলাদেশ বিএনপি’র প্রতি জনগণের গভীর হতাশার স্পষ্ট ইঙ্গিত। কয়েক দশক ধরে উভয় দলই ন্যায্য বা অন্যায়ভাবে দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি এবং রাজনৈতিক সহিংসতার সমার্থক হয়ে উঠেছে, যা ভোটারদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশকে হতাশ করে তুলেছে।
শশী থারুর বলেন, শিবিরের ছাত্রদের এই বিজয় ইসলামী মৌলবাদের প্রতি জোরেশোরে সমর্থনের চেয়ে বরং বিকল্পের জন্য মরিয়া আর্তনাদ। ভোটাররা, যারা ধর্মীয় উগ্র নয়, তারাও জামায়াতের দিকে ঝুঁকছেন – কারণ তারা এর আদর্শের প্রতি আকৃষ্ট নন, বরং এটিকে একমাত্র রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে দেখা হচ্ছে, যা এখনো পুরানো রক্ষীদের ব্যাপক পচনের মতো কলঙ্কিত হয়নি।
তিনি আরও বলেন, ছাত্রদের নেতৃত্বে গণঅভ্যুত্থানের পর শেখ হাসিনার সরকারকে অপসারণের ফলে সৃষ্ট রাজনৈতিক শূন্যতা এই হতাশাকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে। নোবেল বিজয়ী মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে দেশ যখন একটি ভঙ্গুর অন্তর্বর্তীকালীন প্রশাসনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, তখন জনগণ একটি নতুন দিকনির্দেশনা খুঁজছে।
তিনি উল্লেখ করেন, আওয়ামী লীগের দীর্ঘ শাসনামলে দমন ও নির্যাতিত হওয়ার পর, জামায়াত এখন তাদের প্রভাব পুনরুত্থিত এবং সুসংহত করার জন্য একটি উর্বর ভূমি খুঁজে পাচ্ছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো ধর্মনিরপেক্ষ ও প্রগতিশীল রাজনীতির ঘাঁটিতে তাদের বিজয় তাদের ক্রমবর্ধমান আবেদনকে আরও স্পষ্ট করে তোলে, বিশেষ করে নতুন প্রজন্মের ভোটারদের মধ্যে – যারা ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে দলের বিতর্কিত ভূমিকা প্রত্যক্ষ করেননি।
কংগ্রেস নেতা বলেন, ভারত দীর্ঘদিন ধরে যে ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক পরিস্থিতির সঙ্গে মোকাবিলা করতে অভ্যস্ত, তা অস্থির। নয়াদিল্লির একসময়ের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য অংশীদার আওয়ামী লীগ বিশৃঙ্খল অবস্থায় রয়েছে; তার নেতা নির্বাসিত এবং তার ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। যাই হোক না কেন, নিষেধাজ্ঞার অর্থ হল, তারা ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারবে না।
তিনি ‘ভবিষৎবাণী’ করে বলেন, জামায়াত-সংখ্যাগরিষ্ঠ সরকার অথবা নতুন জোটে শক্তিশালী জামায়াতের উপস্থিতি ভারতের জন্য একটি জটিল এবং সম্ভাব্য প্রতিকূল পরিস্থিতি তৈরি করবে। যদিও ভারতের সরকারি পররাষ্ট্রনীতি হস্তক্ষেপ না করার অবস্থান বজায় রাখে, তবে বাস্তবতা হলো যে, আমাদের নিকটবর্তী প্রতিবেশীর ঘটনাগুলো কখনই কেবল ‘অভ্যন্তরীণ বিষয়’ নয়। ঢাকায় আরও উগ্রপন্থী ব্যবস্থা সীমান্তে ভারতবিরোধী উপাদানগুলোকে, বিশেষ করে পাকিস্তানি আইএসআই-এর সহযোগিতায় – এগুলো উৎসাহিত করতে পারে এবং নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জগুলোতে উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি ঘটাতে পারে।
থারুর বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্বাচন আমাদের জন্য একটি সতর্কবার্তা। এটি একটি লক্ষণ, বাংলাদেশের রাজনৈতিক টেকটোনিক প্লেটগুলো স্থানান্তরিত হচ্ছে। ভারত অজ্ঞান থাকার সামর্থ্য রাখে না। নয়াদিল্লিকে পরিস্থিতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করতে হবে, জামায়াতের অভ্যন্তরের উপাদানগুলোসহ সকল উদীয়মান রাজনৈতিক খেলোয়াড়দের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে এবং এমন একটি পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে, যেখানে ঢাকায় আমাদের আর বন্ধুত্বপূর্ণ এবং স্থিতিশীল সরকার নাও থাকতে পারে।
সবশেষে তিনি উল্লেখ করেন, বাংলাদেশের সঙ্গে আমাদের দীর্ঘকাল ধরে নির্ভরশীল কৌশলগত অংশীদারিত্ব ঝুঁকির মুখে পড়তে পারে এবং যত তাড়াতাড়ি আমরা এই নতুন বাস্তবতা স্বীকার করব এবং তার জন্য প্রস্তুত থাকব, তত তাড়াতাড়ি আমরা সামনের চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলা করতে সক্ষম হব।