
পোল্যান্ডে রাশিয়ার কয়েকটি ড্রোনের তথাকথিত ‘অনুপ্রবেশের’ ঘটনা নিয়ে যখন ন্যাটো মিত্ররা উদ্বিগ্ন, তখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বলেছেন, ড্রোনগুলো ‘ভুলবশত’ প্রবেশ করতে পারে। ট্রাম্পের মন্তব্য বেশ কয়েকজন ইউরোপীয় নেতার ‘তীব্র নিন্দার’ সম্পূর্ণ বিপরীত। যেখানে রাশিয়ার ড্রোন প্রবেশকে ‘উস্কানিমূলক’ এবং ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ বলে বর্ণনা করেছে ইউরোপ।
রয়টার্সের প্রতিবেদন অনুসারে, ইউক্রেনে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর প্রথমবারের মতো রাশিয়া ন্যাটো জোটের কোনো দেশের আকাশসীমা লঙ্ঘন করেছে।
ইউরোপীয় কূটনীতিকরা বলছেন, বুধবারের ঘটনার জন্য মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের জনসমক্ষে মস্কোকে দায়ী করতে অস্বীকৃতি এবং এটি প্রতিরোধে মার্কিন অংশগ্রহণের অভাব উদ্বেগজনক।
রয়টার্স বলছে, রাশিয়ার হামলার ক্ষেত্রে মিত্রদের প্রতিরক্ষার প্রতি ট্রাম্পের অঙ্গীকার নিয়ে ইতোমধ্যেই জোটের অনেক সদস্য প্রশ্ন তুলেছেন।
ট্রাম্পের নীরব প্রতিক্রিয়াকে ব্যাপকভাবে ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতির আরেকটি উদাহরণ হিসেবে দেখা হচ্ছে। এটি এজন্য যে, যাতে ইউরোপীয়রা তাদের নিজস্ব নিরাপত্তার জন্য আরও দায়িত্ব নেয় এবং ইউক্রেনে নিজেরা আরও খরচ বহন করে।
তবে কিছু বিশ্লেষক বলেছেন, ট্রাম্প রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের বিরোধিতা করার বিষয়ে হয়তো সতর্ক থাকতে পারেন।
২০০৯ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত ন্যাটোর মার্কিন রাষ্ট্রদূত হিসেবে কাজ করা ইভো ডাল্ডার বলেছেন, এটি স্পাট, রুজভেল্টের পর থেকে সকল প্রেসিডেন্টের বিপরীতে ট্রাম্প ইউরোপের নিরাপত্তাকে আমেরিকান নিরাপত্তার জন্য মৌলিক বলে মনে করেন না।
এ বিষয়ে ট্রাম্পের প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে রয়টার্সের প্রশ্নের সরাসরি জবাব দেয়নি হোয়াইট হাউস। তবে হোয়াইট হাউসের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ‘জো বাইডেনের অযোগ্যতার কারণে সৃষ্ট এই যুদ্ধ যত তাড়াতাড়ি সম্ভব শেষ করতে চান।’
তার মতে, এই সংঘাত বন্ধ করা নির্ভর করছে রাশিয়া এবং ইউক্রেনের ওপর। সেই সঙ্গে ‘যুদ্ধে অর্থায়নকারী’ দেশগুলোর ওপর অর্থনৈতিক চাপ প্রয়োগ করে ইউরোপের ভূমিকা পালন করা।
রয়টার্সের প্রতিবেদন অনুসারে, পোল্যান্ড অন্যান্য ন্যাটো সদস্যদের বিমানের সহায়তায় গত বুধবার তাদের আকাশসীমায় প্রবেশ করা কমপক্ষে ১৯টি ড্রোন গুলি করে ভূপাতিত করেছে।
রাশিয়া বলেছে, তাদের বাহিনী সেই সময় ইউক্রেন আক্রমণ করছিল। পোল্যান্ডের কোনো লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করার উদ্দেশ্য তাদের ছিল না।
কূটনীতিক এবং বিশ্লেষকরা বলছেন, শীতল যুদ্ধের সূচনার পর থেকে অন্য যে কোনো যুগে এই ধরনের ঘটনা সম্ভবত ওয়াশিংটনে উদ্বেগের সৃষ্টি করত, যার ফলে দ্রুত প্রতিক্রিয়া দেখা যেত।
কিন্তু ওয়াশিংটনের নেতৃত্বে ন্যাটো জোটকে প্রশ্নবিদ্ধ করার অতীত রয়েছে ট্রাম্পের। তিনি কিছু ইউরোপীয় কর্মকর্তার ব্যক্তিগত বক্তব্যের জবাবে ‘জনসমক্ষে ‘ঘাড় ঘুরিয়েছেন’।
ট্রাম্প তার ট্রুথ সোশ্যাল প্ল্যাটফর্মে রহস্যময় পোস্টে বলেছেন, ‘ড্রোন দিয়ে পোল্যান্ডের আকাশসীমা লঙ্ঘন করছে রাশিয়া, তাহলে কী হয়েছে? (চলো) এবার শুরু করি!’
পোস্টের একদিন পর রুশ ড্রোন প্রবেশের বিষয়ে সাংবাদিকদের চাপের মুখে ট্রাম্প বলেন, ‘এটি একটি ভুল হতে পারে।’ অর্থাৎ ভুলক্রমে ড্রোনগুলো পল্যান্ডে গিয়ে থাকতে পারে।
কিন্তু ওয়াশিংটনের নিকটতম ইউরোপীয় মিত্রদের একজন পোলিশ প্রধানমন্ত্রী ডোনাল্ড টাস্ক, মার্কিন প্রেসিডেন্টের সঙ্গে বিরল বিরোধিতা করেছেন। শুক্রবার (১৩ সেপ্টেম্বর) তিনি বলেন, ড্রোনগুলো ভুল করে পোল্যান্ডে প্রবেশ করতে পারে, এমন ধারণাকে তারা স্পষ্টভাবে প্রত্যাখ্যান করেছেন।
শুক্রবারের পরে যুক্তরাষ্ট্র পশ্চিমা মিত্রদের সঙ্গে এক যৌথ বিবৃতিতে এ ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে এবং মস্কোর বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আইন ও জাতিসংঘ সনদ লঙ্ঘনের অভিযোগ করে।
‘হালকা’ প্রতিক্রিয়া
রুশ ড্রোনের প্রতি ট্রাম্পের প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া জোটের বিরুদ্ধে ‘হুমকি’র প্রতি পূর্ববর্তী মার্কিন প্রতিক্রিয়ার সঙ্গে বৈপরীত্যপূর্ণ।
২০২২ সালের নভেম্বরে একটি রুশ ক্ষেপণাস্ত্র পোলিশ গ্রামে আঘাত হেনেছে – এমন খবরের পর প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন দ্রুত বিশ্ব নেতাদের একটি জরুরি বৈঠক ডেকেছিলেন এবং তিনি ও তার উপদেষ্টারা ‘সংকট-ব্যবস্থাপনার’ মেজাজে চলে গিয়েছিলেন।
তবে বাইডেন তাড়াহুড়ো করে সিদ্ধান্তে না পৌঁছানোর জন্য সতর্ক করেছিলেন এবং পরে নিশ্চিত হওয়া যায়, এটি ছিল একটি ইউক্রেনীয় বিমান-প্রতিরক্ষা ক্ষেপণাস্ত্র।
তবে রুশ ড্রোন নিশ্চিত হওয়ার পর ট্রাম্পের ভাষা বেশ কয়েকজন ইউরোপীয় নেতার নিন্দার চেয়েও ‘মৃদু’ ছিল। এমনকি ন্যাটোতে তার রাষ্ট্রদূত ম্যাথিউ হুইটেকারেরও চেয়েও। তিনি এক্স-পোস্টে ‘ন্যাটো অঞ্চলের প্রতিটি ইঞ্চি’ প্রতিরক্ষার প্রতিশ্রুতির কথা বলেছেন।
শুক্রবার ব্রাসেলসে ন্যাটো মহাসচিব মার্ক রুট, জোটের পূর্বাঞ্চলের প্রতিরক্ষা জোরদার করার পরিকল্পনা ঘোষণা করে বলেন, ট্রাম্প ‘একেবারে স্পষ্ট করে দিয়েছেন যে, আমরা সবাই এই বিষয়ে একসঙ্গেই আছি’। তিনি মার্কিন প্রতিক্রিয়ায় সন্তুষ্ট বলেও উল্লেখ করেন।
তা সত্ত্বেও ট্রাম্পের মন্তব্যগুলো ইউরোপের দৃষ্টিভঙ্গিতে হতাশা থেকে শুরু করে বিভ্রান্তি এবং অস্বস্তি পর্যন্ত বিস্তৃত। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক কূটনৈতিক সূত্র রয়টার্সকে এমনটা জানান।
একজন জ্যেষ্ঠ জার্মান কর্মকর্তা বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র ন্যাটো মিত্রদের সঙ্গে ড্রোন নিয়ে আলোচনা করেছে, কিন্তু তাদের ‘ইতস্তত’ বলে মনে হচ্ছে। তিনি বলেন, ‘এই মার্কিন প্রশাসনের সঙ্গে আমরা কোনো কিছুর ওপর নির্ভর করতে পারি না। তবে আমাদের ভান করতে হবে যে, আমরা পারব।’
একজন পূর্ব ইউরোপীয় কূটনীতিক বলেছেন, ‘এই মুহূর্তে ন্যাটোর কাউকেই আমেরিকার পক্ষ থেকে বিশেষভাবে আশ্বস্ত করা হয়নি। ওয়াশিংটনের নীরবতা প্রায় বধির করে তুলেছে।’
একজন ইতালীয় কর্মকর্তা বলেছেন, জোটের সদস্যদের এখন পর্যন্ত মার্কিন প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে বেশিরভাগ নেতিবাচক ধারণা ছিল, তবে তারা প্রকাশ্য সমালোচনা এড়িয়ে চলেছে।
ইউরোপের ‘জাগ্রত’ হওয়ার আহ্বান
একই সময়ে কিছু ইউরোপীয় কর্মকর্তা এবং বিশ্লেষক ড্রোন প্রবেশকে ‘ন্যাটোর প্রতিরক্ষা যাচাইয়ের জন্য রাশিয়ার প্রচেষ্টা’ হিসেবে দেখেছেন। তারা এটিকে পশ্চিমাদের জন্য একটি ‘জেগে ওঠার আহ্বান’ হিসাবে বর্ণনা করেছেন।
জ্যেষ্ঠ জার্মান কর্মকর্তা রয়টার্সকে বলেন, ‘ড্রোন হামলা দেখিয়েছে যে, আমরা ড্রোনের বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষার জন্য প্রস্তুত নই। আমাদের যত তাড়াতাড়ি সম্ভব, সক্ষমতা বিকাশ করতে হবে।’
২০০৯ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত ন্যাটো মহাসচিব থাকা আন্দ্রেস ফগ রাসমুসেন স্বীকার করেছেন, ইউরোপ অস্বস্তিতে রয়েছে। তিনি বলেছেন, এখনই ইউরোপের এগিয়ে আসার সময়।
রাসমুসেন বলেন, ‘এর অর্থ হলো, প্রকৃত সম্পদ মোতায়েন করা, ইউক্রেনের প্রতিরক্ষা শিল্পে সরাসরি বিনিয়োগ করা এবং ইউক্রেনের অভ্যন্তরে সুনির্দিষ্ট নিরাপত্তা গ্যারান্টি ও একটি আশ্বাস বাহিনী গঠন। যুক্তরাষ্ট্রকে অবশ্যই এখানে থাকতে হবে।’