
আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে উচ্চকণ্ঠ ঘোষণার চেয়ে নীরব পরিবর্তনগুলো অনেক সময় বেশি শক্তিশালী হয়ে ওঠে। এই বিবেচনায়, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সাম্প্রতিক বেইজিং সফর (সাত বছরের মধ্যে প্রথম) এবং সাংহাই সহযোগিতা সংস্থা (এসসিও) শীর্ষ সম্মেলনের ফাঁকে প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং এর সঙ্গে তার বৈঠককে যুগান্তকারী সাফল্য না বলা গেলেও এর তাৎপর্য মোটেও ছোট নয়।
এই সফর মূলত দ্বন্দ্ব থেকে সংলাপে ফেরার একটি সচেতন পদক্ষেপ। পাঁচ বছর আগে গালওয়ান উপত্যকায় ২০ জন ভারতীয় সেনার প্রাণহানি দুই দেশের সম্পর্ককে গভীর সংকটে ফেলেছিল। সেই সময়ে বাণিজ্য ধীর হয়ে গিয়েছিল, বিমান চলাচল বন্ধ হয়েছিল এবং ‘চিন্ডিয়া’ (চীন-ভারত) শব্দটি সন্দেহ ও অবিশ্বাসের কাছে পরাজিত হয়েছিল। কিন্তু বর্তমানে সম্পর্ক পুনর্গঠনের প্রক্রিয়া আবার শুরু হয়েছে।
দুই দেশের সম্পর্কের প্রতীকী পরিবর্তনগুলো স্পষ্ট। ভারতীয় তীর্থযাত্রীরা আবার তিব্বতের পবিত্র হিন্দু ও বৌদ্ধধর্মীয় স্থানগুলোতে যাচ্ছেন। সরাসরি ফ্লাইট চালু হচ্ছে এবং ভিসার শর্ত সহজ করা হয়েছে। বিতর্কিত সীমান্তে টহলদারিও আবার শুরু হয়েছে। উভয় দেশ উচ্চপর্যায়ের নিয়মিত বৈঠকের মাধ্যমে সম্পর্কের বরফ গলানোর উদ্যোগ নিচ্ছে। এই পদক্ষেপগুলো ছোট মনে হলেও গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এগুলো প্রমাণ করে যে উভয় দেশই অতীতের দোষারোপকে পেছনে ফেলে সম্পর্ককে নতুনভাবে সাজাতে চায়।
ভারত-চীন সম্পর্কের ইতিহাস প্রায় দুই হাজার বছরের পুরোনো। প্রাচীনকালে ‘গোল্ডেন রুট’ এবং সিল্ক রুট শুধু বাণিজ্য পথই ছিল না, বরং ছিল গভীর সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় আদান-প্রদানের সেতু। ২০ শতকের মাঝামাঝি সময়েও এই সহযোগিতা উজ্জ্বল ছিল। উপনিবেশ থেকে বেরিয়ে আসার পর ভারতই চীনকে স্বীকৃতি দেওয়া প্রথম অ-কমিউনিস্ট দেশগুলোর একটি ছিল। ১৯৪০ ও ১৯৫০-এর দশকে বিজ্ঞান, শিক্ষা ও কূটনীতিতে দুই দেশের মধ্যে প্রাণবন্ত আদান-প্রদান শুরু হয়।
এই যুগটি পারস্পরিক সম্মান এবং ‘হিন্দি-চীনি ভাই ভাই’ এর আশাবাদ দ্বারা চিহ্নিত হয়েছিল। বর্তমান সম্পর্ক সেই পুরোনো বন্ধন এবং নতুন আকাঙ্ক্ষার মধ্যে ভারসাম্য খোঁজার চেষ্টা করছে। মোদি-সি বৈঠকের মূল বার্তা ছিল যে, ভারত ও চীন শুধু প্রতিদ্বন্দ্বী নয়, উন্নয়নের সহযোগীও হতে পারে। ‘পার্থক্য যেন বিরোধে রূপ না নেয়’—এই কথাটি নিছক স্লোগান নয়, বরং একটি সচেতন প্রচেষ্টা।
২০২০ সালের পর যখন চারদিকে ‘হিন্দি-চীনি বাই বাই’ শোনা যাচ্ছিল, তখন এই নতুন অবস্থানকে গুরুত্ব না দিয়ে উপায় নেই। বিশেষ করে যখন বিশ্বজুড়ে বাণিজ্যযুদ্ধ এবং জোটের সমীকরণ দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে, তখন এই স্পষ্টতা বিশেষভাবে প্রয়োজনীয়। তবে এই নতুন বোঝাপড়ার ওপর আমেরিকার শুল্কনীতির কালো ছায়া ভেসে বেড়াচ্ছে। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প চীনা পণ্যের ওপর ৩০ শতাংশ শুল্ক বসিয়েছেন এবং তা ১৪৫ শতাংশে তোলার হুমকি দিয়েছেন।
ভারতীয় রপ্তানির ওপরও ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে নয়াদিল্লি নতুন করে কৌশল ভাবতে বাধ্য হয়েছে। যে ভারত একসময় আমেরিকার কাছে মূল্যবান অংশীদার ছিল, আজ ওয়াশিংটনের চোখে সেই ভারত ‘ক্রেমলিনের টাকা সাদা করার আস্তানা’ হয়ে উঠেছে। এর প্রভাব ভারতের রপ্তানি, শিল্প এবং কর্মসংস্থানের ওপর পড়েছে।
তবে চীন ভারতকে কাছে টানার চেষ্টা করছে। তারা ভারতীয় পণ্য কিনছে, ভারতে দ্রুত বিনিয়োগ করছে এবং আমেরিকার শুল্কনীতির সমালোচনা করছে। এর পেছনে কেবল সুযোগ বুঝে স্বার্থ উদ্ধারের মানসিকতা দেখলেই চলবে না; বরং এটি একটি বড় সত্যকে তুলে ধরে। সেটি হলো, এশিয়ার এই দুটি বড় দেশ বুঝতে পেরেছে যে, বর্তমান বহুমাত্রিক বিশ্বে টিকে থাকতে হলে তাদের একে অপরের পাশে থাকা দরকার। তাই ‘কৌশলগত স্বায়ত্তশাসন’ এখন আর কেবল ফাঁকা বুলি নয়, এটি দুই দেশের জন্য বাস্তবিকভাবে টিকে থাকার পথ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তবে বাস্তবতাকে অস্বীকার করা যায় না। দুই দেশের সীমান্ত এখনো সংঘাতের ঝুঁকিতে রয়েছে। ২০২০ সালের এপ্রিলের আগের পরিস্থিতিতে ফিরতে কোনো দৃশ্যমান অগ্রগতি হয়নি। চীনের সঙ্গে ভারতের বিশাল বাণিজ্যঘাটতি রয়ে গেছে। এছাড়াও, চীনের নানা ধরনের অশুল্ক-বাধা সেই বাণিজ্যঘাটতি আরও বাড়িয়ে তুলেছে। দুই দেশের সম্পর্কের মধ্যে যে সামরিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক অসমতা রয়েছে, তা সহজে দূর হবে না। এর একটি সাম্প্রতিক উদাহরণ হলো ফক্সকনের কারখানা থেকে ৩০০ জনের বেশি চীনা প্রকৌশলীর চলে যাওয়া।
তামিলনাড়ু ও কর্ণাটকে আইফোন ১৭ তৈরির জন্য এই কারখানাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এটি দেখিয়ে দেয় যে, বেইজিং চাইলে ভারতের উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে কতটা সহজে চাপের মুখে ফেলতে পারে। চীন বিরল খনিজ উৎপাদন ও প্রক্রিয়াকরণে তার আধিপত্য কাজে লাগিয়ে ভারতের জন্য প্রয়োজনীয় খনিজ এবং চুম্বকের রপ্তানি সীমিত করেছে। এছাড়াও ইলেকট্রনিকস অ্যাসেম্বলির যন্ত্রপাতি, ভারী টানেল বোরিং মেশিন এবং সৌর সরঞ্জামসহ উচ্চমানের বহু পুঁজিসামগ্রী রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে, যা ভারতের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। তাই এই সম্পর্কের আসল পরীক্ষা শুধু শীর্ষ বৈঠকের প্রতীকী অঙ্গভঙ্গিতে নয়, বরং দীর্ঘস্থায়ী সহযোগিতার বাস্তবতায় নিহিত।
এখনো আশার আলো আছে। ভারত আর চীন আবার আলোচনা শুরু করেছে, জনগণের মধ্যে যোগাযোগ ফিরিয়ে আনছে এবং আন্তর্জাতিক বিষয়গুলোতে একসঙ্গে কাজ করার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে। এর অর্থ, তারা একে অপরকে কেবল প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দেখছে না, বরং সমস্যার সমাধান খোঁজার জন্য আলোচনার সঙ্গী হিসেবেও ভাবছে।
আজকের বিশ্বে প্রতিযোগিতা এমনভাবে চলছে যেখানে একজনের লাভ মানেই আরেকজনের ক্ষতি, কিন্তু ভারত-চীনের এই পরিবর্তিত দৃষ্টিভঙ্গি দেখাচ্ছে যে তারা একসঙ্গে জেতার পথ খুঁজছে। তাই এটাকে একধরনের বিজয় বলা যায়। মনে হচ্ছে, ‘চিন্ডিয়া’র চেতনা আবারও জেগে উঠছে। এটি ধীরে ধীরে এবং সতর্কভাবে হলেও নিশ্চিতভাবেই জেগে উঠছে। আশা করা যায়, এই চেতনা দীর্ঘস্থায়ী হবে।
সূত্র: ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস