
গেল ৭২ ঘণ্টা যেন দুঃস্বপ্নের মতো কেটেছে বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলের জন্য। প্রীতি ম্যাচ খেলতে নেপালে গিয়ে হঠাৎ অগ্নিগর্ভ রাজনৈতিক পরিস্থিতির মুখে আটকা পড়েছিলেন জামাল ভূঁইয়া, মিতুল মারমাসহ লাল-সবুজের যোদ্ধারা। সহিংসতায় কেঁপে উঠেছিল পুরো কাঠমান্ডু। আগুন, ভাঙচুর আর গুলির শব্দে আতঙ্কিত পরিবেশে হোটেলবন্দি হয়েই দিন কাটাতে হয় দলকে। অবশেষে তিন দিনের শ্বাসরুদ্ধকর অপেক্ষার পর বৃহস্পতিবার বিকালে স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন তারা।
বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর একটি বিশেষ ফ্লাইটে বিকাল সাড়ে চারটায় ঢাকার কুর্মিটোলায় বাংলাদেশ বিমান বাহিনী ঘাঁটি বীর-উত্তম একে খন্দকারে নিরাপদে অবতরণ করেন খেলোয়াড়, কোচ, টিম অফিশিয়ালসহ ৩৮ জন। একই ফ্লাইটে ফিরেছেন ম্যাচ কাভার করতে যাওয়া ১৬ জন সাংবাদিকও। এ সময় কাঠমান্ডু থেকে আসা সবাইকে অভ্যর্থনা জানাতে উপস্থিত ছিলেন বিমান, সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও বাফুফে সভাপতিসহ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গ।
গেল সোমবার থেকে প্রতিটি মুহূর্তই ছিল নেপালে ঝুঁকিপূর্ণ। দেশটির তরুণদের সরকারবিরোধী আন্দোলনের ক্ষোভে পুড়েছে পুরো দেশ। এর মধ্যেই নেপালের বিরুদ্ধে দুটি প্রীতি ম্যাচ খেলতে গিয়ে আটকা পড়েছিল বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দল। প্রথম ম্যাচটি খুব ভালোভাবে খেলতে পারলেও দ্বিতীয় ম্যাচের আগেই অস্থির হয়ে ওঠে গোটা দেশ। খুব কাছ থেকে দল দেখেছে সহিংসতাও। তাদের ফিরিয়ে আনতে বিমানের একটি ফ্লাইট মঙ্গলবার কাঠমান্ডু গেলেও ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অনুকূল পরিস্থিতি না থাকায় নামার অনুমতি পায়নি। পরে সেটি ঢাকায় ফিরে আসে।
আর এই অস্থিরতার মধ্যে প্রতিটি মিনিট যেন গুনে গুনে হোটেলে পার করেছেন ফুটবলাররা। বাইরে দাউ দাউ করে জ্বলছে সরকারি ভবন, রাস্তায় ভাঙচুর চলছে, রাজনীতিবিদদের বাড়িঘরে আগুন ছড়াচ্ছে ক্ষোভ। টিভি পর্দা আর জানালার বাইরে থেকে আসা ধোঁয়ার দৃশ্য একটাই বার্তা দিচ্ছিল-জীবন এখানে আর নিরাপদ নয়। ভেতরে আটকে থাকা জাতীয় দলের খেলোয়াড়রা তখন শুধু অপেক্ষা করেছেন, কবে তারা ফিরতে পারবেন প্রিয় মাতৃভূমিতে। তবে সেই অপেক্ষা যেন শেষই হচ্ছিল না।
অবশেষে তাদের সেই অপেক্ষা শেষ হয়েছে বৃহস্পতিবার। রাতেই নিশ্চিত হওয়া গিয়েছিল যে, এদিন সকালে দল ও আটকে পড়া গণমাধ্যমকর্মীদের উদ্ধার করতে বিশেষ বিমান নিয়ে আসবে বিমান বাহিনী। যদিও তারা সকালে আসেননি। আসতে আসতে গড়িয়েছে দুপুর। তবে দল সকাল থেকেই উপস্থিত হয়েছিল বিমানবন্দরে। গতকাল সকালে কাঠমান্ডুর ক্রাউন ইম্পিরিয়াল হোটেল থেকে বের হয়ে স্থানীয় সময় পৌনে ৯টায় বিমানবন্দরে পৌঁছায় বাংলাদেশ দল। সকাল সকাল সেখানে ইমিগ্রেশন সম্পন্ন করলেও দলকে বিমানে চড়তে অপেক্ষা করতে হয় লম্বা সময়। বেলা ২টা ৪০ মিনিটে দেশের বিমান ধরেন ফুটবলাররা।
এমন পরিস্থিতিতে নেপালে থাকা জাতীয় দলের খেলোয়াড়দের নিয়ে তাদের পরিবারের সবাই বেশ চিন্তিত ছিল। সেখানে ফেসবুক-হোয়াটস অ্যাপের মতো জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো ৯ তারিখ সকাল অবধি বন্ধ থাকায় দেশে যোগাযোগ করতে ব্যাঘাত পেতে হয়েছিল খেলোয়াড়দের। এর মধ্যে ৮ তারিখের সহিংসতার খবর পত্র-পত্রিকায় এবং টিভিতে দেখে দেখে আরও শঙ্কিত হয়ে পড়েছিল তাদের পরিবাররা। শুধু পরিবার নয়, পরিস্থিতি দেখে খেলোয়াড় নিজেরাও আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিলেন। দলের অধিনায়ক জামাল ভূঁইয়া বলেন, ‘সারা রাত ঘুমোতে পারিনি, ভয়ে ছিলাম। কখন কী হয়-এ নিয়েই ভাবতাম। তবে দেশে ফিরে ভালো লাগছে।’
তার এমন লাগাটা স্বাভাবিক; কারণ তাদের হোটেলের বাহিরে বিক্ষোভ হয়েছিল। তাদের হোটেলেও হামলা চালানোর চেষ্টা হয়েছিল। অতটুকু হলেও হয়তো ভুলে যাওয়ার মতো হতো। কিন্তু না, ৯ তারিখ টিম হোটেলের পাশে এক রাজনীতিবিদের বাড়িতে আগুন দিয়েছিল আন্দোলনকারীরা, যা খুব কাছ থেকেই দেখেছেন বাংলাদেশের অধিনায়ক। তাই দেশে ফেরা পর্যন্ত যে ঘুমটা তার হবে না, তা বলাই যায়। তবে জামাল একা না, একই পরিস্থিতি ছিল প্রতিটা খেলোয়াড়ের।
স্বাভাবিকভাবেই নেপালে এমন পরিস্থিতিতে তিন দিন কাটিয়ে আসার পর খেলোয়াড়রা মানসিকভাবে খানিকটা বিপর্যস্ত। হয়েছে যা, কাটাতে দ্রুতই উদ্যোগ নেবে বাফুফে, এমনটি জানিয়েছেন সংস্থাটির সভাপতি তাবিথ আউয়াল। তিনি বলেন, ‘আমাদের চিকিৎসার প্রক্রিয়া রয়েছে। সেখানে অবশ্যই আমরা মানসিক কোচিং, সাইকোলজিক্যাল সাপোর্ট দেবো, যাদের প্রয়োজন হয়। যাদের লাগবে না, তাদেরও আমরা অ্যাসেসমেন্ট করবো; কারণ অনেক সময় এরকম পরিস্থিতিতে ফিজিক্যাল শক হয়। আমরা এই বিষয়ে সচেতন রয়েছি। পাশাপাশি বাংলাদেশ আর্মড ফোর্সের মেডিক্যাল টিম প্রস্তুত ছিল ফুটবলারদের বিশেষভাবে চিকিৎসাজনিত কিছু প্রয়োজন হলে।’
এ সময় বিশেষ বিমানে দলকে দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য সংশ্লিষ্টদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেন তিনি। বলেন, ‘প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়, পররাষ্ট্র ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়, জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ, বাংলাদেশ দূতাবাস কাঠমান্ডুর সবাই আন্তরিকভাবে সহায়তা করেছে। বিশেষভাবে কৃতজ্ঞতা জানাতে চাই বাংলাদেশ বিমান বাহিনী, আর্মি এবং আর্মড ফোসর্ডকে যারা সফলভাবে কাঠমান্ডু থেকে সবাইকে নিয়ে দেশে নিয়ে এসেছে।’
এর আগে মঙ্গলবার নেপালে দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ, অগ্নিসংযোগ ও সহিংসতায় রূপ নিলে দেশটির প্রধানমন্ত্রী কে পি শর্মা ওলি পদত্যাগ করেন। বিক্ষোভকারী ব্যক্তিরা রাজনীতিবিদদের বাড়িঘরে ভাঙচুর চালান। সরকারি ভবন ও পার্লামেন্টে আগুন ধরিয়ে দেন। দুই দিনের সহিংসতায় ২৫ জন নিহত হয়। এমন পরিস্থিতির মধ্যে বন্ধ করে দেওয়া হয় ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। পরে গত বুধবার সন্ধ্যার পর বিমানবন্দর খুলে দেয় কর্তৃপক্ষ। বাংলাদেশ দল চেয়েছিল গতকাল রাতেই ফিরতে। ঢাকা থেকে বিশেষ ফ্লাইটের চেষ্টা চালানো হয়, শেষ পর্যন্ত তা হয়নি। পরে দুপুরের বিশেষ ফ্লাইটে দেশে ফেরে দল।