
পরিবর্তন, পরিমার্জন ও কিছু শব্দ-বাক্যের সংশোধন করে এবার বহুল আলোচিত ‘জুলাই জাতীয় সনদ-২০২৫’ এর ‘চূড়ান্ত ভাষ্য’ ৩৩টি রাজনৈতিক দল-জোটকে পাঠিয়েছে প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন ‘জাতীয় ঐকমত্য কমিশন’। গতকাল বৃহস্পতিবার রাতে খসড়াটি পাঠানো হয়।
চূড়ান্ত ভাষ্যে ‘জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের অঙ্গীকারনামা’য় সাত দফা অঙ্গীকারের কথা বলা হয়েছে। সনদের পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন, এই সনদ পূর্ণাঙ্গভাবে সংবিধানে তফসিল হিসেবে বা যথোপযুক্তভাবে সংযুক্ত করার এবং সনদের বৈধতা ও প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে কোনো আদালতে প্রশ্ন না তোলার অঙ্গীকার রয়েছে এই চূড়ান্ত ভাষ্যে। আদালতে প্রশ্ন না তোলার অঙ্গীকারের সঙ্গে এটাও বলা হয়েছে, ‘উপরন্তু উক্ত সনদ বাস্তবায়নের প্রতিটি ধাপে আইনি ও সাংবিধানিক সুরক্ষা নিশ্চিত করব’।
এছাড়া, চূড়ান্ত ভাষ্যে ‘জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের অঙ্গীকারনামা’য় রয়েছে- গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য জনগণের দীর্ঘ ১৬ বছরের নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রাম এবং বিশেষত ২০২৪ সালের অভূতপূর্ব গণঅভ্যুত্থানের ঐতিহাসিক তাত্পর্যকে সাংবিধানিক তথা রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি প্রদান; গণঅভ্যুত্থানপূর্ব ১৬ বছরের ফ্যাসিবাদবিরোধী গণতান্ত্রিক সংগ্রামে খুন, গুম ও নির্যাতনের শিকার হওয়া ব্যক্তিদের এবং ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানকালে সংঘটিত সকল হত্যাকা্লের বিচার, শহিদদের রাষ্ট্রীয় মর্যাদা প্রদান ও শহিদ পরিবারসমূহকে যথোপযুক্ত সহায়তা প্রদান এবং আহতদের সুচিকিত্সা ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা; ঐকমত্যের ভিত্তিতে গৃহীত যেসব সিদ্ধান্ত অবিলম্বে বাস্তবায়নযোগ্য সেগুলো কালক্ষেপণ না করে দ্রুততম সময়ে অন্তর্বর্তী সরকার ও অন্যান্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ সম্পূর্ণরূপে বাস্তবায়ন করবে।
রাজনৈতিক দল ও জোটের কাছে পাঠানো এই চূড়ান্ত ভাষ্যে ৮৪টি বিষয়ে ঐকমত্য সৃষ্টির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এসব সংস্কার প্রস্তাবে কতটি রাজনৈতিক দল-জোট একমত, কতটি একমত নয় তাও সংযোজন করা হয়েছে। কোন কোন প্রস্তাবে ঐকমত্য হয়েছে, সেটি উল্লেখ করা হয়েছে। পাশাপাশি কোন কোন প্রস্তাবে কোন কোন দল ও জোট ‘নোট অব ডিসেন্ট’ (আপত্তি) দিয়েছে সেটিও উল্লেখ করা হয়েছে।
সনদ বাস্তবায়নের উপায় নিয়ে গতকাল রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে রাজনৈতিক দল-জোটগুলোর সঙ্গে প্রায় দিনভর আলোচনা করেছে ঐকমত্য কমিশন। বিকালে আলোচনা শেষে রাতেই সনদের চূড়ান্ত ভাষ্য দলগুলোর কাছে পাঠায় কমিশন। সনদে সই করার জন্য আগামীকাল শনিবার বিকাল পাঁচটার মধ্যে প্রতিটি দল-জোটকে দু’জনের নাম প্রস্তাব করে তা কমিশনের কাছে পাঠাতে অনুরোধ করা হয়েছে। এরপর রবিবার আবারও দল-জোটগুলোর সঙ্গে বসবে কমিশন।
সনদে সবার মতের প্রতিফলন ঘটানো হয়েছে: আলী রীয়াজ
গতকাল দলগুলোর সঙ্গে বৈঠক শেষে ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ সংবাদ ব্রিফিংয়ে বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে জুলাই জাতীয় সনদের চূড়ান্ত ভাষ্য পাঠানো হয়েছে। এ সনদে সকলের মতের প্রতিফলন ঘটানো হয়েছে।
তিনি বলেন, সনদ বাস্তবায়নের পদ্ধতি নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে গতকালের আলোচনায় দুটি বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে। সুপারিশের যেসব বিষয় সংবিধান সংশ্লিষ্ট নয় সেসব বিষয় বাস্তবায়নের জন্যে অন্তর্বর্তী সরকার অধ্যাদেশ জারি করতে পারে এবং সুপারিশের যেসব বিষয় সরকারি বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের আদেশ ও বিধি প্রনয়ণের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা সম্ভব সেগুলো অন্তর্বর্তী সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বাস্তবায়ন করতে পারে৷ সরকার এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে ইতোমধ্যে অধ্যাদেশ জারি ও যথাযথ পদক্ষেপের মাধ্যমে তা বাস্তবায়নের কাজ শুরু হয়েছে বলেও উল্লেখ করেন তিনি। এসময় কমিশনের সদস্য বিচারপতি মো. এমদাদুল হক, ড. ইফতেখারুজ্জামান, ড. বদিউল আলম মজুমদার, ড. মো. আইয়ুব মিয়া এবং ঐকমত্য গঠন প্রক্রিয়ায় যুক্ত প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার উপস্থিত ছিলেন।
সালাহউদ্দিন ও ডা. তাহের যা বললেন
ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে বৈঠক শেষে বিএনপির প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দানকারী দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ সাংবাদিকদের বলেন, বিএনপি সনদে সই করার জন্য প্রস্তুত। অন্যদিকে, জামায়াতের নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের সাংবাদিকদের বলেন, বিশেষ সাংবিধানিক আদেশের মাধ্যমে জুলাই সনদের বাস্তবায়ন চায় জামায়াত। বিশেষ সাংবিধানিক আইন জারির প্রস্তাবের ভিত্তিতে জুলাই সনদ বাস্তবায়িত না হলে গণভোটের মাধ্যমে হবে। আর এনসিপির সদস্য সচিব আখতার হোসেন বলেন, সংবিধান সম্পর্কিত সংকট সমাধানের একমাত্র উপায় গণভোট।