
বিশ্বের বৃহত্তম জীবাশ্ম জ্বালানি কোম্পানিগুলো চলতি শতাব্দীতে শত শত তাপপ্রবাহ তীব্র করেছে বলে আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান সাময়িকী ন্যাচারের প্রকাশিত এক গবেষণায় উঠে এসেছে। এসব তাপপ্রবাহে বিশ্বব্যাপী ৫ লক্ষের অধিক মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। গতকাল ১০ সেপ্টেম্বর বুধবার প্রকাশিত এই গবেষণাটি।
গবেষণায় ২০০০ সাল থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে সংঘটিত ৬৩ দেশের ২১৩টি তাপপ্রবাহ বিশ্লেষণ করেছেন বিজ্ঞানীরা। তাতে দেখা যায়, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এসব তাপপ্রবাহ কতটা ঘন ঘন ও তীব্র হয়েছে। এসব তাপপ্রবাহ আরও জটিল হওয়ার ক্ষেত্রে ১৮০টি বৃহৎ জীবাশ্ম জ্বালানি ও সিমেন্ট কোম্পানির অবদান ছিল অনেক বেশি। এসব কোম্পানিকে বৈশ্বিকভাবে কার্বন মেজর হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।
প্রথমবারের মতো এই গবেষণা নির্দিষ্ট কোম্পানিগুলোকে সরাসরি প্রাণঘাতী তাপপ্রবাহের সঙ্গে যুক্ত করেছে। যেমন- ২০২১ সালের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্যাসিফিক নর্থওয়েস্ট হিট ডোম এবং ২০২৩ সালের ইউরোপীয় তাপপ্রবাহ। দায়ী কোম্পানিগুলোর মধ্যে রয়েছে সৌদি আরামকো, রাশিয়ার গ্যাজপ্রম, মার্কিন এক্সনমোবিল, শেভরন এবং ব্রিটিশ কোম্পানি বিপি ও শেল।
জাতিসংঘের আন্তঃসরকারি জলবায়ু পরিবর্তন প্যানেল (আইপিসিসি) বহুবার সতর্ক করেছে যে মানবসৃষ্ট জলবায়ু পরিবর্তন প্রধানত গ্রিনহাউস গ্যাস দ্বারা চালিত। ১৯৫০ এর দশক থেকে বিশ্বজুড়ে তাপপ্রবাহের ঘনত্ব ও তীব্রতা বাড়িয়ে তুলেছে। এখন প্রতিটি তাপপ্রবাহই জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আরও ঘন ঘন ও প্রাণঘাতী হয়ে উঠছে।
গবেষণায় বলা হয়েছে, চরম তাপ মানুষের জন্য মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ, কারণ এটি শরীরের শীতলীকরণ প্রক্রিয়া ব্যাহত করে এবং হিটস্ট্রোকসহ নানা প্রাণঘাতী রোগের ঝুঁকি বাড়ায় এবং প্রতি বছর হাজারো মানুষ তীব্র গরমের কারণে প্রাণ হারাচ্ছে।
গবেষণার অন্যতম লেখক রিচার্ড হিডে বলেছেন, এখন প্রথমবারের মতো বৈজ্ঞানিকভাবে নির্দিষ্ট তাপপ্রবাহের সঙ্গে নির্দিষ্ট কোম্পানির দায় যুক্ত করা সম্ভব হয়েছে। এর ফলে জীবাশ্ম জ্বালানি শিল্প কেবল সামগ্রিকভাবে নয়, বরং পৃথক কোম্পানিও আইনি ও সামাজিকভাবে দায়ী হতে পারে।
গবেষণায় বলা হয়েছে, বৈশ্বিক উষ্ণায়নের অর্ধেকই এই ১৮০ কোম্পানির কারণে হচ্ছে। এর মধ্যে মাত্র ১৪টি কোম্পানি একাই বাকিদের সমপরিমাণ নির্গমন ঘটিয়েছে। এটি প্রথমবার নয় যে জীবাশ্ম জ্বালানি কোম্পানিগুলোকে সরাসরি জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী করা হলো। চলতি বছরের মার্চে প্রকাশিত আরেক গবেষণায় দেখা গেছে, মাত্র ৩৬টি কোম্পানি বিশ্বের অর্ধেকেরও বেশি কার্বন ডাইঅক্সাইড নির্গমনের জন্য দায়ী।
গবেষণায় বলা হয়েছে, বিশ্বব্যাপী, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রে, জীবাশ্ম জ্বালানি কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে মামলা বাড়ছে। অভিযোগগুলোর মধ্যে রয়েছে ক্ষয়ক্ষতির দায়, ভুয়া সবুজ প্রচারণা এবং জলবায়ু ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার ঘাটতি।
গ্রানথাম রিসার্চ ইনস্টিটিউটের সিনিয়র পলিসি ফেলো ক্যাথরিন হাইহ্যাম বলেন: ‘সরকার ও কোম্পানিগুলো ক্রমেই বুঝতে পারছে, তেল ও গ্যাস প্রকল্প চালু রাখলে আদালতে জবাবদিহি করতে হবে।’
গত জুলাইয়ে আন্তর্জাতিক বিচার আদালত জলবায়ু পরিবর্তনের দায় নিয়ে ঐতিহাসিক মতামত দিয়েছে। যেখানে বলা হয়েছে জীবাশ্ম জ্বালানি উৎপাদন একটি আন্তর্জাতিক বেআইনি কর্মকাণ্ড হিসেবে বিবেচিত হতে পারে এবং ভুক্তভোগীরা ক্ষতিপূরণ পাওয়ার অধিকারী।
গবেষকরা বলেছেন, ন্যাচারের এই গবেষণাই আদালতের জন্য বহু প্রতীক্ষিত প্রমাণ। আমরা এখন স্পষ্ট করে বলতে পারি কে দায়ী। ক্ষতির হিসাব মেটানোর সময় এসেছে—এবং এই দূষণকারীদের তাদের অপরাধের জন্য মূল্য দিতে হবে।