
নেপালে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নিষিদ্ধের প্রতিবাদে হওয়া সহিংস বিক্ষোভের জেরে প্রধানমন্ত্রী কে পি শর্মা ওলির পদত্যাগ ঘটেছে। ভারতের এই কৌশলগত প্রতিবেশী দেশে চলমান অস্থিরতা দিল্লিকে গভীর দুশ্চিন্তায় ফেলেছে, যা তাদের বাংলাদেশ এবং শ্রীলঙ্কার সাম্প্রতিক সংকটের কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে। বৃহস্পতিবার (১১ সেপ্টেম্বর) ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানিয়েছে।
সংবাদমাধ্যমটি জানিয়েছে যে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সহিংস আন্দোলনের কারণে সরকার পতন হওয়া নেপাল ভারতের তৃতীয় ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী। ওলি পদত্যাগ করেছেন, এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নিষিদ্ধের প্রতিবাদে হওয়া বিক্ষোভে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে অন্তত ২০ জন নিহত হয়েছেন। দেশজুড়ে কারফিউ জারি করা হয়েছে এবং সেনাবাহিনী পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে। বিক্ষোভকারীরা সংসদ ভবনে হামলা চালিয়েছে এবং কয়েকজন রাজনীতিবিদের বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। কাঠমান্ডুর এই দৃশ্য অনেকের কাছে গত বছর বাংলাদেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং ২০২২ সালে শ্রীলঙ্কার অভ্যুত্থানের সময়ের চিত্র স্মরণ করিয়ে দিয়েছে।
যদিও বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কাও ভারতের ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী, তবে নেপালের সঙ্গে দিল্লির সম্পর্ক ঐতিহাসিক, অর্থনৈতিক এবং কৌশলগত কারণে বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। নেপালের সঙ্গে ভারতের প্রায় ১ হাজার ৭৫০ কিলোমিটার উন্মুক্ত সীমান্ত রয়েছে, যা মূলত উত্তরাখণ্ড, উত্তরপ্রদেশ, সিকিম, বিহার এবং পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে সংযুক্ত। সীমান্তের ওপারে চলমান ঘটনাপ্রবাহের ওপর ভারত গভীর নজর রাখছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী দ্রুত প্রতিক্রিয়া জানিয়ে এক্স (পূর্বের টুইটার) এ লিখেছেন, ‘নেপালের সহিংসতা হৃদয়বিদারক। এত তরুণ প্রাণহানিতে আমি মর্মাহত।’ তিনি আরও বলেন, ‘নেপালের স্থিতিশীলতা, শান্তি ও সমৃদ্ধি অত্যন্ত জরুরি।’ গত মঙ্গলবার তিনি তার মন্ত্রিসভার সহকর্মীদের সঙ্গে একটি জরুরি বৈঠকও করেছেন।
বিশ্লেষকরা বলছেন যে, ২০২২ সালে শ্রীলঙ্কার রাজনৈতিক অস্থিরতায় ভারত যেমন অপ্রস্তুত হয়েছিল, তেমনি নেপালের এই পরিস্থিতিও তাদের বিস্মিত করেছে। বিশেষ করে ওলির দিল্লি সফরের ঠিক এক সপ্তাহ আগে তার পদত্যাগ ঘটনাটিকে আরও তাৎপর্যপূর্ণ করে তুলেছে। নেপালের কৌশলগত অবস্থানের কারণে এই অস্থিরতা ভারতের জন্য উদ্বেগের কারণ। কারণ দেশটির সীমানার ওপারেই চীনের পশ্চিমাঞ্চলীয় সামরিক কমান্ডের অবস্থান রয়েছে। ভারতীয় বিশেষজ্ঞরা বলছেন যে, ইন্দো-গাঙ্গেয় সমভূমিতে প্রবেশের পথ সরাসরি নেপালের ভেতর দিয়ে গেছে।
এই অস্থিরতা ভারতের অভ্যন্তরেও প্রভাব ফেলছে, কারণ ভারতে প্রায় ৩৫ লাখ নেপালি বসবাস বা কাজ করেন। উভয় দেশের মধ্যে গভীর পারিবারিক সম্পর্ক এবং অবাধ যাতায়াত রয়েছে। নেপালি নাগরিকরা ভিসা বা পাসপোর্ট ছাড়াই ভারতে ভ্রমণ এবং কাজ করতে পারেন। এছাড়াও, নেপালের প্রায় ৩২ হাজার গুর্খা সেনা বিশেষ চুক্তির অধীনে ভারতীয় সেনাবাহিনীতে কর্মরত রয়েছেন।
নেপাল হিন্দু ধর্মীয় ঐতিহ্যের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। প্রতি বছর হাজার হাজার ভারতীয় হিন্দু ভক্ত মুকতিনাথসহ নেপালের বিভিন্ন মন্দিরে তীর্থযাত্রায় যান। ভারতের সঙ্গে নেপালের বার্ষিক বাণিজ্যের পরিমাণ ৮.৫ বিলিয়ন ডলার। মূলত কাঠমান্ডু তেল ও খাদ্যপণ্যের জন্য ভারতের ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল।
যদিও বুধবার কিছুটা শান্ত পরিস্থিতি ফিরে এসেছে, তবে বিশ্লেষকরা বলছেন যে, ভারতকে এখন অত্যন্ত সতর্ক কূটনৈতিক কৌশল অবলম্বন করতে হবে। কারণ বিক্ষোভকারীরা নেপালের তিনটি প্রধান রাজনৈতিক দল—ওলির নেতৃত্বাধীন সিপিএন-ইউএমএল, শের বাহাদুর দেউবার নেপালি কংগ্রেস এবং পুষ্পকমল দাহাল প্রচণ্ডর নেতৃত্বাধীন সিপিএন (মাওবাদী কেন্দ্র)—সবকটির বিরুদ্ধেই ক্ষুব্ধ। ওলির উত্তরসূরী কী ধরনের সরকার গঠন করবেন, তা এখনো স্পষ্ট নয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, ভারত এখন খুবই সতর্ক থাকবে। তারা নেপালে বাংলাদেশের মতো পরিস্থিতি চায় না।
২০১৯ সালে ভারতের নতুন মানচিত্রে বিতর্কিত সীমান্ত অঞ্চল অন্তর্ভুক্ত করায় নেপাল ক্ষুব্ধ হয়েছিল এবং পরে নেপালও পাল্টা মানচিত্র প্রকাশ করে। সম্প্রতি ভারত ও চীন ওই বিতর্কিত সীমান্ত দিয়ে বাণিজ্য পুনরায় শুরু করতে সম্মত হয়েছে, যা নিয়ে ওলি চীনা নেতৃত্বের কাছে আপত্তি জানিয়েছিলেন। বিশ্লেষকরা মনে করেন যে, ভারতের উচিত নতুন নেপালি নেতৃত্বের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলা এবং রাজনৈতিক ব্যবস্থা নিয়ে ক্ষুব্ধ তরুণ প্রজন্মকে পাশে টানা। এর জন্য শিক্ষাবৃত্তি ও কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়ানো প্রয়োজন। দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা (সার্ক) দীর্ঘদিন ধরে অকার্যকর থাকায় ভারতের জন্য প্রতিবেশী দেশগুলোর এই অস্থিরতা মোকাবিলা করা আরও কঠিন হয়ে পড়ছে। কারণ পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক তলানিতে, বাংলাদেশের সঙ্গে দিল্লির টানাপোড়েন চলছে এবং মিয়ানমার গৃহযুদ্ধে জর্জরিত।
ভারতীয় বিশেষজ্ঞ অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল অশোক মেহতা মন্তব্য করেছেন, ‘ভারত তার বৃহৎ শক্তি হওয়ার স্বপ্নে মগ্ন, কিন্তু সেই লক্ষ্য অর্জন করতে হলে আগে নিজের প্রতিবেশে স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।’