
স্বাধীনতার পর থেকে দেশে সাক্ষরতার হার বেড়েছে। তবে শতভাগ সাক্ষরতা নিশ্চিতে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে দারিদ্র্য। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, দেশের দারিদ্র্যের হার যত কমেছে, সাক্ষরতার হার তত বেড়েছে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের দারিদ্র্যের হার ছিল ৮০ শতাংশের বেশি আর সাক্ষরতার হার ছিল মাত্র ১৬ দশমিক ৮ শতাংশ। বর্তমানে দেশে দারিদ্র্যের সেই হার নেমে দাঁড়িয়েছে ২৮ শতাংশে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ প্রতিবেদন ‘বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা-২০২৪’ অনুযায়ী দেশের সাত বছর ও তদূর্ধ্ব জনগোষ্ঠীর মধ্যে বর্তমানে সাক্ষরতার হার ৭৭ দশমিক ৯ শতাংশ। সেই হিসাবে ২২ দশমিক ১ শতাংশ জনগোষ্ঠী এখনো নিরক্ষর। ২০১০ সালে দেশে সাক্ষরতার হার ছিল ৫৯ দশমিক ৮২ শতাংশ। দেড় দশকে সাক্ষরতার হার বেড়েছে ১৮ দশমিক ০৮ শতাংশ। এদিকে এক বছরের ব্যবধানে ৪ হাজার বেসরকারি প্রাইমারি বিদ্যালয় ও ২ লাখ শিক্ষার্থী বাড়লেও ঝরে পড়ার হার বেড়েছে ৩ শতাংশ।
বিশেষজ্ঞদের মতে, সাক্ষরতার হার নিয়ে সরকারি ও বেসরকারি তথ্যে বড় ধরনের ফারাক রয়েছে। সাক্ষরতার আন্তর্জাতিক সংজ্ঞার সঙ্গেও আমাদের কার্যক্রমের মিল নেই। এ কারণে দেশকে নিরক্ষরমুক্ত করার পরিকল্পনা দিনদিন কঠিন হয়ে যাচ্ছে। এ অবস্থায়ই বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো দেশেও বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্য দিয়ে যথাযোগ্য মর্যাদায় আজ পালিত হবে ‘আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস-২০২৫’। ইউনেসকো নির্ধারিত এবারের আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবসের প্রতিপাদ্য ‘প্রযুক্তির যুগে সাক্ষরতার প্রসার’। ২০০৮ সালের নির্বাচনি ইশতেহারে আওয়ামী লীগের ঘোষণা ছিল ২০১৪ সালের মধ্যে দেশ থেকে নিরক্ষরতা দূর করা হবে। কিন্তু নির্ধারিত সময়ের পর ১০ বছর পেরিয়ে গেলেও তা বাস্তবায়িত হয়নি। এমন পরিস্থিতিতে ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনে দেশকে নিরক্ষরমুক্ত করা নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছে। দেশের প্রায় ৪ কোটি মানুষ বহুমাত্রিক দারিদ্র্যের শিকার, যা মোট জনসংখ্যার ২৪ দশমিক ০৫ শতাংশ। আর এই হার সবচেয়ে বেশি পাহাড়ি জেলা বান্দরবানে ৬৫ দশমিক তিন ৬ শতাংশ। পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগ (জিইডি) প্রকাশিত ‘ন্যাশনাল মালটিডাইমেনশনাল পভার্টি ইনডেক্স (এমপিআই) ফর বাংলাদেশ’ শীর্ষক সম্প্রতি প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।
আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস উপলক্ষে বাণী দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস। বাণীতে তিনি বলেন, সাক্ষরতা একটি জাতির উন্নয়ন ও অগ্রগতির জন্য অতি প্রয়োজনীয় উপাদান। প্রযুক্তিনির্ভর এই আধুনিক পৃথিবীতে সাক্ষরতার ধারণা আজ শুধু পড়ালেখার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ডিজিটাল জ্ঞান, তথ্য ব্যবহারের দক্ষতা এবং প্রযুক্তিনির্ভর শিক্ষায় অংশগ্রহণের সক্ষমতা। এখন তথ্য খুঁজে বের করা, বিশ্লেষণ করা, অনলাইনে শেখা ও দৈনন্দিন সমস্যার সমাধান খোঁজা—এ সবই কার্যকর সাক্ষরতার অংশ। তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহারে যারা পিছিয়ে পড়ছে, তারা কেবল শিক্ষাবঞ্চিতই নয়, বরং সমাজ ও অর্থনীতির মূল স্রোত থেকেও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবসের এ বছরের প্রতিপাদ্য ‘প্রযুক্তির যুগে সাক্ষরতার প্রসার’ সময়োপযোগী ও অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ হয়েছে বলে আমি মনে করি। প্রধান উপদেষ্টা বলেন, বর্তমান প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে টিকে থাকার জন্য কর্মমুখী ও দক্ষতাভিত্তিক শিক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম।
সত্যিকার অর্থে সাক্ষরতার হার আরও কম: গণশিক্ষা উপদেষ্টা: প্রাথমিক ও গণশিক্ষা উপদেষ্টা বিধান রঞ্জন রায় পোদ্দার বলেছেন, ‘দেশে সাক্ষরতার হার বর্তমানে ৭৭ দশমিক ৯ শতাংশ। বাকি ২২ দশমিক ১ শতাংশ জনগোষ্ঠী নিরক্ষর। তবে সত্যিকার অর্থে সাক্ষরতার হার আরও কম হতে পারে। আগের সরকার প্রকৃত সাক্ষরতার হার চেপে রেখেছিল। স্কুলে স্কুলে ভিজিট করে দেখা গেছে, প্রকৃত সাক্ষর নয়, অনেক শিক্ষার্থী রয়েছে। গতকাল রবিবার সচিবালয়ে আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস উপলক্ষে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, ‘নিরক্ষর জনগোষ্ঠী মূলত বিদ্যালয়বহির্ভূত বা ঝরে পড়া শিশু এবং শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত প্রাপ্তবয়স্ক নারী-পুরুষ। উন্নত ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গঠনের জন্য তাদের সাক্ষরজ্ঞান ও কর্মমুখী প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ মানবসম্পদে রূপান্তরিত করা অত্যন্ত জরুরি।
১৮টি জেলায় এখনো ২৫ শতাংশের বেশি মানুষ লিখতে বা পড়তে পারে না: এক জরিপে দেখা গেছে, দেশের ১৮টি জেলায় এখনো ২৫ শতাংশের বেশি মানুষ লিখতে বা পড়তে পারে না। এ ২৫ শতাংশের সিংহভাগের নিরক্ষতার পেছনে দায়ী দারিদ্র্য। পাশাপাশি রয়েছে অবকাঠামো ও জনবল ঘাটতি, মাঠপর্যায়ের দুর্বলতা ও সমন্বয়হীনতা। এ অবস্থায় সাক্ষরতার হার বাড়াতে শিক্ষার্থী ও সংশ্লিষ্ট পরিবারগুলোর আর্থসামাজিক পরিস্থিতি বিবেচনায় কার্যকর ও সমন্বিত পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন বলে অভিমত দেন শিক্ষাবিদরা। দেশে নিরক্ষরতার হারের দিক থেকে শীর্ষে পার্বত্য জেলা বান্দরবান। আবার দারিদ্র্যের হারের দিক থেকেও শীর্ষে থাকা জেলাগুলোর অন্যতম বান্দরবান। বান্দরবানের পর নিরক্ষরতার হারে শীর্ষ অবস্থানে রয়েছে যথাক্রমে—ময়মনসিংহ বিভাগের দারিদ্র্যপ্রবণ জেলা জামালপুর, শেরপুর ও নেত্রকোনা এবং উত্তরাঞ্চলের দারিদ্র্যপ্রবণ জেলা কুড়িগ্রাম। দারিদ্র্যের কারণে দেখা যায়, অভিভাবকরা সন্তানদের স্কুলে না পাঠিয়ে কর্মে নিয়োজন করেন। এতে একদিকে অসচ্ছল পরিবারগুলোকে শিক্ষায় ব্যয় করতে হয় না, অন্যদিকে উপার্জন আসে। দারিদ্র্যপ্রবণ এলাকাগুলোয় সাক্ষরতার হার বাড়াতে সরকারি উপবৃত্তি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। কিন্তু বর্তমানে শিক্ষার্থীদের যে পরিমাণ উপবৃত্তি দেওয়া হয়, দেশে দীর্ঘদিন ধরে বিরাজমান মূল্যস্ফীতি ও শিক্ষার্থীদের পরিবারগুলোর আর্থিক অবস্থা বিবেচনায় তা যৎসামান্য। উপবৃত্তির অর্থের পরিমাণ বাড়ানো উচিত।
তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণিতে পড়া অনেক শিক্ষার্থীরই বাংলা বর্ণ ও গণিতের সংখ্যা চিনতে সমস্যা হয়: ইউনেসকোর সংজ্ঞা অনুযায়ী সাক্ষরতা বলতে পড়া, অনুধাবন করা, মৌখিকভাবে এবং লেখার বিভিন্ন পদ্ধতিতে ব্যাখ্যা, যোগাযোগ স্থাপন এবং গণনা করার দক্ষতাকে বোঝায়। অন্যভাবে বললে, সাক্ষরতা বলতে লিখতে, পড়তে, গণনা করতে ও যোগাযোগ স্থাপন করার সক্ষমতাকে বোঝায়। এর সঙ্গে নতুন যুক্ত হয়েছে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহারের যোগ্যতা। তবে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের (বিআইডিএস) এক গবেষণা বলছে, অনেক শিক্ষার্থী স্কুলগামী হলেও তারা সঠিকভাবে পড়তে ও গণনা করতে শিখছে না। পাঠ্যক্রম অনুযায়ী একজন শিক্ষার্থীর প্রাক-প্রাথমিকেই বাংলা বর্ণমালা ও গণিতের ১ থেকে ২০ পর্যন্ত শিখে ফেলার কথা। প্রতিবেদন অনুযায়ী, তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণিতে পড়া অনেক শিক্ষার্থীরই বাংলা বর্ণ ও গণিতের সংখ্যা চিনতে সমস্যা হয়। শিক্ষাবিদরা বলেন, প্রকৃত অর্থে সাক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন মানুষ তৈরিতে শিক্ষার মানোন্নয়নের বিকল্প নেই।
দেশে প্রতি চার জনের একজন এখন গরিব: দেশে বিগত তিন বছরে দারিদ্র্য বেড়েছে। প্রতি চার জনের এক জন এখন গরিব। আরও অনেক মানুষ এমন আর্থিক অবস্থায় রয়েছেন যে, অসুস্থতা বা অন্য কোনো সংকটে তারা গরিব হয়ে যাওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছেন। ২০২০ সালে করোনা মহামারির আগে তিন দশক ধরে বাংলাদেশে দারিদ্র্যের হার কমছিল। এখন দেখা যাচ্ছে, সেটা বাড়ছে। এটা বাংলাদেশের আর্থসামাজিক অগ্রযাত্রা পিছিয়ে যাওয়ার লক্ষণ। দারিদ্র্যের এ হিসাব উঠে এসেছে বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের (পিপিআরসি) এক গবেষণায়। অর্থ মন্ত্রণালয়ের সহায়তায় করা ‘ইকোনমিক ডায়নামিকস অ্যান্ড মুড অ্যাট হাউজহোল্ড লেভেল ইন মিড ২০২৫’ শীর্ষক এ গবেষণায় বলা হয়, গত মে মাসে এসে দেশের দারিদ্র্যের হার দাঁড়িয়েছে প্রায় ২৮ শতাংশে, যা ২০২২ সালে সরকারি হিসাবে (পরিসংখ্যান ব্যুরোর খানা আয়-ব্যয় জরিপ) ছিল ১৮ দশমিক ৭ শতাংশ। পিপিআরসি বলছে, দরিদ্র্যের বাইরে এখন দেশের ১৮ শতাংশ পরিবার হঠাত্ দুর্যোগে যে কোনো সময় দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে যাওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। তিন বছরে অতি বা চরম দারিদ্র্যের হারও বেড়েছে। ২০২২ সালের অতি দারিদ্র্যের হার ছিল ৫ দশমিক ৬ শতাংশ, যা ২০২৫ সালে দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৩৫ শতাংশে। দারিদ্র্যের এ হিসাব উঠে এসেছে বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের (পিপিআরসি) এক গবেষণায়।
শিক্ষাবিদরা বলেন, সাক্ষরতার হার বাড়াতে বছর জুড়ে তেমন কোনো কার্যক্রম লক্ষ করা না গেলেও দিবস এলে নড়েচড়ে বসে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরো। ফলে সাক্ষরতার হার বাড়ছে অনেকটা ‘কচ্ছপগতিতে’। এ অবস্থা চলতে থাকলে সাক্ষরতার হার শতভাগে উন্নীত করার যে লক্ষ্য তা শিগগিরই পূরণ হবে না।