
আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালত (আইসিসি)-এ ইসরায়েলি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে তদন্তে সমর্থন দেওয়ার কারণে যুক্তরাষ্ট্র তিনটি ফিলিস্তিনি মানবাধিকার সংস্থার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। ইসরায়েল এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানালেও, অধিকারকর্মীরা একে ন্যায়বিচারের ওপর নির্মম আঘাত বলে নিন্দা জানিয়েছেন।
বৃহস্পতিবার (৪ সেপ্টেম্বর) যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও জানান, আল-হক, আল-মিজান সেন্টার ফর হিউম্যান রাইটস এবং প্যালেস্টিনিয়ান সেন্টার ফর হিউম্যান রাইটস (পিসিএইচআর)-কে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ফেব্রুয়ারিতে স্বাক্ষরিত এক নির্বাহী আদেশের অধীনে কালো তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। গাজায় যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে আইসিসি গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির পর এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল।
রুবিও বলেন, ‘এই সংস্থাগুলো ইসরায়েলের সম্মতি ছাড়াই ইসরায়েলি নাগরিকদের তদন্ত, গ্রেপ্তার, আটক বা বিচার করতে আইসিসি’র প্রচেষ্টায় প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত ছিল।’ তিনি আরও দাবি করেন, যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল রোম স্ট্যাটিউটের সদস্য নয়, তাই আইসিসি’র এখতিয়ারের অধীনেও নয়। তার ভাষায়, ‘আমরা আইসিসি’র রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এজেন্ডা, এখতিয়ার অতিক্রম এবং যুক্তরাষ্ট্র ও আমাদের মিত্রদের সার্বভৌমত্ব অস্বীকারের প্রবণতার বিরোধিতা করি।’
এই নিষেধাজ্ঞার সময়ে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের একাধিক কর্মকর্তা জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে যোগ দিতে নিউইয়র্ক ভ্রমণের ভিসা পাননি। যুক্তরাষ্ট্রের এই পদক্ষেপটি আসে ফ্রান্স, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া এবং বেলজিয়ামের মতো দেশগুলো ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেওয়ার ঘোষণা দেওয়ার পরপরই। বৃহস্পতিবার রুবিও সতর্ক করে বলেন, ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেওয়া ‘গুরুতর সমস্যা তৈরি করবে’।
ইসরায়েল ওয়াশিংটনের এই সিদ্ধান্তকে কৃতজ্ঞতার সঙ্গে গ্রহণ করেছে। দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী গিডিওন সা’আর বলেন, ‘আইসিসি’র রাজনৈতিক এজেন্ডায় সহায়তাকারী ফিলিস্তিনি সংস্থাগুলোকে লক্ষ্যবস্তু করায় আমি রুবিও’র কাছে কৃতজ্ঞ।’ ইসরায়েলের জাতিসংঘ দূত ড্যানি ড্যাননও যুক্তরাষ্ট্রের পদক্ষেপকে স্বাগত জানিয়ে বলেন, এই সংস্থাগুলো শুধু ইসরায়েলের বিরুদ্ধেই নয়, বরং যুক্তরাষ্ট্র এবং সমগ্র পশ্চিমের বিরুদ্ধেও কাজ করেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের এই নিষেধাজ্ঞার কড়া প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ও নিষেধাজ্ঞার আওতায় আসা ফিলিস্তিনি সংস্থাগুলো। অ্যামনেস্টির গবেষণা ও অ্যাডভোকেসি বিভাগের সিনিয়র পরিচালক এরিকা গুয়েভারা-রোসাস বলেন, ‘এই সিদ্ধান্ত মানবাধিকার ও ন্যায়বিচারের বৈশ্বিক প্রচেষ্টার ওপর গভীর উদ্বেগজনক ও লজ্জাজনক আঘাত।’ তিনি আরও বলেন, ‘সংস্থাগুলো ভয়ংকর পরিস্থিতিতেও গুরুত্বপূর্ণ কাজ চালিয়ে যাচ্ছে এবং সতর্কতার সঙ্গে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা নথিভুক্ত করছে। এই পদক্ষেপ পুরো ফিলিস্তিনি মানবাধিকার আন্দোলনের ওপর নির্লজ্জ আক্রমণ এবং বিশ্বব্যাপী মানবাধিকার সম্প্রদায়কে দুর্বল করার এক নিষ্ঠুর প্রচেষ্টা।’
আল-হক, আল-মিজান এবং পিসিএইচআর এক যৌথ বিবৃতিতে মার্কিন নিষেধাজ্ঞাকে ‘কাপুরুষোচিত, অনৈতিক, অবৈধ ও অগণতান্ত্রিক’ বলে অভিহিত করেছে। তারা অভিযোগ করেছে, ওয়াশিংটন ইসরায়েলের ব্যাপক নৃশংস অপরাধের শিকারদের জন্য জবাবদিহি নিশ্চিত করার প্রচেষ্টা ধ্বংস করতে চায়।
উল্লেখ্য, গত নভেম্বরে আইসিসি গাজায় যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু ও সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্তের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে। পাশাপাশি, ইসরায়েল বর্তমানে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে (আইসিজে) গণহত্যার মামলার মুখোমুখি।
গাজার স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষের হিসেবে, ইসরায়েলের যুদ্ধে এখন পর্যন্ত ৬৪ হাজার ২০০-এর বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে। ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে পুরো জনপদ, প্রায় সমগ্র জনগোষ্ঠী বাস্তুচ্যুত ও দুর্ভিক্ষে পড়েছে। অধিকার সংস্থাগুলোর আশঙ্কা, মার্কিন নিষেধাজ্ঞা আন্তর্জাতিক জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজনীয় প্রমাণ সংগ্রহের প্রচেষ্টা ব্যাহত করবে। ফিলিস্তিনি সংস্থাগুলোর মতে, ‘যারা মানবতার প্রতি সম্পূর্ণ অবজ্ঞা পোষণ করে কেবল তারাই এমন পদক্ষেপ নিতে পারে।’
সূত্র: টিআরটি ওয়ার্ল্ড