
ডায়াবেটিস রোগীদের জীবন রক্ষার অন্যতম ওষুধ ইনসুলিন উৎপাদনে দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলো হুমকির মুখে পড়তে যাচ্ছে। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান উৎপাদন প্রায় বন্ধ করে দিচ্ছে। ইনসুলিন উৎপাদনকারী ওষুধ কোম্পানির পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, তারা দেশে গুণমানসম্পন্ন ইনসুলিন ২০০৭ সাল থেকে তৈরি করে আসছে। দেশীয় উৎপাদিত গুণমানসম্পন্ন ইনসুলিনের বাজারমূল্যের চেয়ে বিদেশ থেকে আমদানিকৃত ইনসুলিনের বাজারমূল্য দ্বিগুণেরও বেশি। এতে বিপাকে পড়েছে দেশি ওষুধ কোম্পানি এবং ডায়াবেটিস রোগীরা। ইনসুলিনের মূল্য বৈষম্যের কারণে উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ও রোগীরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এই মূল্য বৈষম্যের কারণে দেশ থেকে প্রচুর ডলারও বিদেশ চলে যাচ্ছে।
এদিকে আমদানিকৃত ইনসুলিনের ওপর প্রাইজ বেনিফিট দেওয়া হচ্ছে। অন্যদিকে ইনসুলিন তৈরির কাঁচামালের মূল্য বেড়েই চলেছে। এতে দেশে উৎপাদিত ইনসুলিনের খরচ বাড়ছে। সরকার দেশে উৎপাদিত ইনসুলিনের যৌক্তিক মূল্য সামঞ্জস্য না করার কারণে নানা চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছেন ওষুধ উৎপাদনকারীরা। মানসম্পন্ন ইনসুলিন উৎপাদন করার ক্ষমতা দেশ অনেক আগেই অর্জন করেছে। নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারের রোগীরা সাশ্রয়ী মূল্যে দেশে তৈরি ইনসুলিন ক্রয় করছে। অন্যদিকে আমদানিকৃত একই মানের ইনসুলিন বেশি দামে অভ্যন্তরীণ বাজারে বিক্রি হচ্ছে বলে ওষুধ শিল্প সমিতির পক্ষ থেকে জানানো হয়।
দেশে একটি নামদামি ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের অন্যতম কর্ণধার ইত্তেফাককে বলেন, আমদানিকৃত ইনসুলিন যে কাঁচামাল দিয়ে তৈরি সেই একই মানের কাঁচামাল দিয়ে দেশে তৈরি হচ্ছে ইনসুলিন। এতে ইনসুলিনের গুণমান নিয়ে কোনো ধরনের পার্থক্য নেই বলে তিনি জানান। দেশের স্বনামধন্য বেশ কয়েকটি ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান অনেক আগ থেকে ইনসুলিন উৎপাদন করে আসছে। দেশের চাহিদা মিটিয়ে অনেক দেশে ইনসুলিন রপ্তানিও করা হচ্ছে। ঐসব দেশে বাংলাদেশের উৎপাদিত ইনসুলিন গুণমান নিয়ে প্রশংসা অর্জন করছে এবং চাহিদা বেড়ে চলেছে। বেশ কয়েক জন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক বলেছেন, ‘আমাদের দেশে উৎপাদিত ইনসুলিনের গুণমান উন্নতমানের।’
ওষুধ শিল্প সমিতিসহ চিকিৎসকদের মতে সারা দেশে প্রায় ১৩ লাখ ডায়াবেটিস রোগী নিয়মিত ইনসুলিন ব্যবহার করে আসছে। এর মধ্যে দেশের তৈরি ইনসুলিন ব্যবহার করে ৬০ ভাগ রোগী এবং আমদানিকৃত ইনসুলিন ব্যবহার করে ৪০ ভাগ রোগী। এই ৪০ ভাগ ডায়াবেটিস রোগীর আমদানিকৃত ইনসুলিনে ব্যয় ৬০ কোটি টাকা এবং ৬০ ভাগ রোগীর ইনসুলিনের ব্যয় ৩২ কোটি টাকা বলে উক্ত সমিতি ও চিকিৎসক সূত্রে জানা যায়। নামিদানি একাধিক ওষুধ বিক্রয়কারী প্রতিষ্ঠানও একই তথ্য জানায়।
১৪ বছর আগে দেশের ওষুধ কোম্পানিগুলো কর্তৃক উৎপাদিত একটি ইনসুলিন মূল্য নির্ধারণ করা হয় ২২২ টাকা। বিগত সময়ে ডলার-সংকট, কাঁচামালের দাম কয়েক গুণ বৃদ্ধি পেলেও এখনো ইনসুলিন পূর্বে নির্ধারিত ২২২ টাকায় বিক্রয় করা হচ্ছে। পাশাপাশি বিদেশ থেকে আমদানিকৃত একটি ইনসুলিন একই সময় ২৫০ টাকা মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছিল। গত ১০ বছরে ধাপে ধাপে আমদানিকৃত প্রতিটি ইনসুলিনের দাম এসে ৬৩৫ টাকায় দাঁড়িয়েছে। ইনসুলিনের দামের এই বৈষম্যের কারণে দেশীয় উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে আসছে।
ওষুধ শিল্প সমিতির মহাসচিব ডা. জাকির হোসেন বলেন, ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য ট্যাবলেট ও ক্যাপসুল বহু বছর ধরে দেশীয় ওষুধ কোম্পানিগুলো তৈরি করে আসছে। বিদেশি ওষুধের তুলনায় দেশীয় তৈরি ট্যাবলেট ও ক্যাপসুলের গুণমান ভালো।
২০০৭ সাল থেকে ইনসুলিন তৈরি শুরু করে দেশীয় নামিদামি ওষুধ কোম্পানিগুলো। ইনসুলিন মূল্যের এই বৈষম্য নিরসন করা দেশীয় উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ও রোগীদের বৃহত্তর স্বার্থে জরুরি বলে তিনি অভিমত পোষণ করেন।
ওষুধ বিক্রেতারা বলেন, বেশির ভাগ চিকিৎসকের মানসিকতা পরিবর্তন করা জরুরি। দেশীয় উৎপাদিত গুণমানের ইনসুলিনের ব্যবহার বাড়ানো দেশের স্বার্থে জরুরি। এতে ইনসুলিনের নামে প্রচুর ডলার বিদেশে যাওয়াও বন্ধ হয়ে যাবে বলে ওষুধ বিক্রেতারা অভিমত ব্যক্ত করেন।
ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের পরিচালক শফিকুল ইসলাম বলেন, গত নভেম্বর থেকে জনস্বার্থে ইনসুলিনের দাম বাড়ানো হয়নি। এখনো বাড়ানোর পরিকল্পনা নেই বলে তিনি জানান।