
বেগম খালেদা জিয়া আপদমস্তক একজন খেলাপ্রিয় নেত্রী ছিলেন। তার ভেতরে খেলার প্রতি একটা সুপ্ত টান ছিল, যা অনেকটাই অজানা। নিজেও কখনো প্রকাশ করতেন না। খেলাধুলার মানুষগুলোকে কীভাবে সচ্ছল করা যায়-তার জন্য সব সময় অকৃপণভাবে সহযোগিতা করেছিলেন তিনি। ক্রীড়াঙ্গন ছিল রাজনীতি থেকে আলাদা।
পারিবারিকভাবেই খেলাধুলার আবহে খালেদা জিয়ার জীবন কেটেছে। স্বামী শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানকে খেলার মাঠে ছুটতে দেখেছেন প্রেসিডেন্ট গোল্ডকাপ ফুটবল টুর্নামেন্ট তখন উপমহাদেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে এশিয়ার ফুটবলে প্রতিষ্ঠিত করার পেছনের কারিগর ছিলেন জিয়াউর রহমান। উত্তর কোরিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া থেকে ফুটবল দল প্রেসিডেন্ট গোল্ডকাপ ফুটবলে অংশগ্রহণ করত।
খালেদা জিয়া যখন প্রথমবার প্রধানমন্ত্রী হলেন তার সময়ে প্রেসিডেন্ট গোল্ডকাপ ফুটবলে ইউরোপীয়ান দল আনার উদ্যোগ গ্রহণ করেন তিনি। ইউরোপীয়ান ফুটবল দল খেলে গেছে ঢাকায়। তার সময়ে বিশ্ব ফুটবলে খুব পরিচিত কোচ জার্মানির অটো ফিস্টারকে আনিয়ে ছিলেন সাংস্কৃতিক চুক্তির আওতায়। সে বছরই ১৯৯৫ সালে অটো ফিস্টারের কোচিংয়ে মিয়ানমারে প্রথম বার আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্ট চার জাতি ফুটবলে চ্যাম্পিয়ন হয় বাংলাদেশ ফুটবলাররা মনে করতেন খালেদা জিয়া ভাগ্যবতী মেয়ে।
তার ভাগ্য খুবই ভালো, ফুটবলে চ্যাম্পিয়ন হয় বাংলাদেশ। ২০০১ সালে খালেদা জিয়া দ্বিতীয় বার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর ২০০৩ সালে প্রথমবার ঢাকায় অনুষ্ঠিত সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে বাংলাদেশ ফুটবল দল চ্যাম্পিয়ন হয়। ভারতকে সেমিফাইনালে হারিয়েছিল ফাইনালে মালদ্বীপকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়। সাফের উদ্বোধন করেন খালেদা জিয়া। চ্যাম্পিয়ন দলকে তার অফিসে নিয়ে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। খেলোয়াড়রা প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার কাছে অর্থ পুরস্কার দাবি করেছিলেন।
কিন্তু খালেদা জিয়া সব ফুটবলারকে জমি বরাদ্দ দেন। তিনি মনে করতেন, ‘খেলোয়াড়রা অর্থনৈতিকভাবে সচ্ছল না। খেলাধুলা করে তারা দেশকে সম্মান এনে দেন। অথচ অবসরের পর তাদেরকে কষ্টের জীবন কাটাতে হয়। ফুটবলারদেরকে প্লট দিয়ে দাও।’ তার এই কথা তখন প্রশংসা কুড়িয়েছিল। সাফ চ্যাম্পিয়ন বাংলাদেশ দলের ম্যানেজার ছিলেন ছাঈদ হাসান কানন। তিনি জানালেন টাকা দাবি করা হলেও জমি দিয়েছিলেন। ম্যাডাম বলেছিলেন, ‘খেলোয়াড়রা শেষ বয়সে মাথা গোঁজার ঠাঁই পান না। প্লট বরাদ্দ দেওয়া হলে তাদের জন্য ভালো হবে।’
বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনে অনেক সাফল্য তার সময়ে এসেছে। তিনি প্রধানমন্ত্রী না থাকলেও দেশের খেলাধুলায় কোনো সাফলা এলে সেই সব ক্রীড়াবিদদেরকে ডেকে নিয়ে সংবর্ধনা দিয়েছেন। আইসিসি ক্রিকেটে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর খালেদা জিয়া বিরোধী দলে থাকলেও তিনি ক্রিকেটারদেরকে সংবর্ধনা দিয়েছেন। বিসিবি সভাপতি আমিনুল ইসলাম বুলবুল খালেদা জিয়াকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করে বলেন, ‘আমার স্মৃতি আছে কিছু। আমাদের সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে। আইসিসি ট্রফিতে ১৯৯৭ সালে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলাম। বিএনপির তরফ থেকে আমাদের সংবর্ধনা দিয়েছিল মিন্টো রোডে। আমি সহ-অধিনায়ক ছিলাম, তখন ডায়াসে উঠেছিলাম। বক্তৃতার এক পর্যায়ে আমি একটা ভুল বক্তৃতা দিয়েছিলাম। উনি ছিলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী, কিন্তু আমি উনাকে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেছিলাম।’
বিসিবি জানিয়েছে সার্ক ক্রিকেটে যখনই বাংলাদেশের। খেলোয়াড়রা ভালো পারফরম্যান্স করতেন তখনই খালেদা জিয়া ক্রিকেটারদেরকে তার অফিসে ডেকে সম্মান জানাতেন ক্রীড়া সংগঠক কোন রাজনীতির মানুষ, সেটি কখনো আমলে নিতেন না। জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কার পরিয়ে দিয়েছেন আওয়ামী ঘরনার ক্রীড়া সংগঠকদের গলায়।
১৯৯১ সালে স্বাধীনতা গোল্ডকাপ ফুটবল ফাইনালে মোহামেডান-আবাহনী। পুরস্কার দেবেন প্রধান অতিথি প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া। মঞ্চে কারা থাকবেন এটি নিয়ে তখন অনেক আলোচনা, পরিকল্পনা। বাফুফের সাধারণ সম্পাদক হারুনুর রশিদ, যিনি আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সম্পৃক্ত। খালেদা জিয়া রাজনীতিকে খেলার মঞ্চে না আনার নির্দেশ দিলেন। হারুনুর রশিদ বিএনপির সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার পাশে দাঁড়িয়ে। পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে অংশ নিলেন।
পারিবারিক সূত্রে খালেদা জিয়ার দুই সন্তান তারেক রহমান এবং আরাফাত রহমান। তারেক রহমান রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে গেলেও ছোট ভাই বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডে ডেভেলপম্যান্ট কমিটির চেয়ারম্যান হয়ে ক্রিকেটের উন্নয়নে কাজ শুরু করলেন। মিরপুরে হোম ক্রিকেট হওয়ার পেছনে সব অবদান প্রয়াত আরাফাত রহমানের। তিনি একক উদ্যোগে তার কিছু বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে গড়ে তুলেছিলেন হোম অব ক্রিকেট।
প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন খালেদা জিয়া ঢাকা স্টেডিয়ামে ফুটবল টুর্নামেন্টের ফাইনালে পুরস্কার বিতরণ করতে নাতনি ছোট্ট জাইমা রহমানকে সঙ্গে এনেছিলেন। মঞ্চে খালেদা জিয়ার সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ সব মন্ত্রী এবং সংগঠকরা উপস্থিত ছিলেন। ট্রফি তুলে দেওয়ার সময়, ট্রফির গায়ে বাড়িয়ে দেওয়া জাইমা রহমানের হাত দেখে সবাই তাকে বাহবা জানিয়ে হাততালি দিয়ে সাহসী মেয়ে বলেছিলেন।
শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান খেলাধূলা ভালোবাসতেন। খালেদা জিয়া খেলাধূলা ভালোবাসতেন। সন্তানরা খেলাধুলা ভালোবাসতেন। খেলাধুলার আবহে ছিল এই নেত্রীর জীবন সংগ্রামী এই মানুষটি তার রাজনৈতিক জীবনেও খেলাধুলা একটি বিশেষ অধ্যায় হয়ে লুকিয়ে ছিল। খেলাধুলার অঙ্গনেও তিনি আজীবন বেঁচে থাকবেন।