
বাংলাদেশের নারী ফুটবলের সাজানো বাগানে অশুভ হাত পড়েছে। বছরের পর বছর দীর্ঘ পরিশ্রমে গড়ে ওঠা নারী ফুটবলের ইমেজ কাজে লাগিয়ে একটা পক্ষ বাণিজ্য করতে চাইছে। নারী ফুটবলাররা তাদের পারফরম্যান্স দেখিয়ে দেশকে সাফল্য উপহার দিয়েছেন। আর সেটিকে বড় পুঁজি ধরে নিয়ে বাণিজ্যিক ফায়দা লুটতে চাইছে। এক যুগের বেশি সময় ধরে দিন-রাত অক্লান্ত পরিশ্রম করে দেশের নারী ফুটবলকে এতদূর আনা হয়েছে। সাফ ছেড়ে এশিয়ার ফুটবলে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশ। সেই সাফল্যকে বাণিজ্যিকীকরণ করতে গিয়ে খেলার চেয়ে বাণিজ্যের পেছনে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।
এ সব নিয়ে ফেডারেশন সংগঠকদের মধ্যেই অনেক আগেই সম্পর্কের টানাপোড়েন শুরু হয়েছে। ঘরের কথা আর ঘরে থাকছে না। স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে বাণিজ্য করতে চাওয়া নেপথ্যে থাকা মানুষের মুখ। বিভক্তির স্পষ্ট রেখা। কর্মকর্তাদের মধ্যে সম্পর্কের ফাটল।
নারী ফুটবল লিগ শুরু হওয়ার কথা রয়েছে ২৯ ডিসেম্বর। একবার বলা হচ্ছে জাতীয় দলের খেলোয়াড়দের নিয়ে পুল হবে, আবার বলা হচ্ছে পুল হবে না। পুল হওয়ার কথা তো আমরা বলিনি। কোনটা সত্য, সেটাই প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। নারী ফুটবল কমিটির চেয়ারম্যান মাহফুজা আক্তার কিরণ। তিনি-ই মূলত নারী ফুটবলটাকে দেখে আসছেন, এক যুগেরও বেশি সময় ধরে। পরশু দুপুরে তিনি সংবাদমাধ্যমকে পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছেন, কোনো পুল হবে না। ‘যা শুনেছেন কীভাবে শুনেছেন জানি না। আমি বলতে পারি পুল হবে না।’
এক মাসের মধ্যে লিগ শেষ করতে হবে। এত তড়িঘড়ি করে কেন লিগ শেষ করতে হবে। মাসের পর মাস সময় চলে গেল। এখন বছরের শেষ দিকে এসে এক মাসের সময় বেঁধে দিয়ে লিগ হবে। ১১ দল নিয়ে। এক রাউন্ডের খেলা হবে। একটা মাঠে খেলতে হবে। এ ধরনের লিগ খুব একটা সুফল বয়ে আনে না মনে করছেন কিরন। তিনি বললেন, ‘এক মাঠে শুধু কি মেয়েরা খেলবে? ছেলেদের ফুটবল আছে না। মেয়েদের লিগ-ই হবে একটা। এটা আরও বেশি সময় নিয়ে হতে পারত। লিগটা এখন করতে হচ্ছে কম সময়ের মধ্যে। যাই হোক, এখন সামনে এশিয়া কাপ খেলতে যাবে বাংলাদেশ। সেই প্রস্তুতি হিসাবেই হবে এই লিগ।’
বয়সভিত্তিক ফুটবলাররাও এবার লিগে খেলতে নিয়ম বেঁধে দেওয়া হয়েছে। এটাতে আপত্তি ছিল কিরনের। তিনি বলেন, ‘বয়সভিত্তিক ফুটবলারদের নিয়ে আলাদা লিগ হওয়া ভালো। এখন এটা করা হয়েছে তারাও এশিয়া কাপে খেলবে যেন খেলার মধ্যে থাকে।’
কিরণ বলেন, ‘এভাবে প্রপার লিগ হয় না। অনূর্ধ্ব-২০ এবং সিনিয়রদের প্রিপারেশনের জন্য ঠিক আছে। আর যদি প্রপার লিগ করতে চাই তাহলে আমি কখনোই অনূর্ধ্ব-১৭, অনূর্ধ্ব-২০ ফুটবলারদের নিয়ে লিগ আয়োজন করব না। আমি কেন অনূর্ধ্ব-১৭, অনূর্ধ্ব-২০ ফুটবলারদের নিয়ে কম্বিনেশন করব। তাদের জন্য প্রয়োজনে আলাদা লিগ করব। আমি চাই, ফরেন ফুটবলার হতে পারে দুই জন। একজন খেলবে। এখানে দেশি ফুটবলারদের সুযোগটা বেশি দিতে হবে। যেহেতু মার্চে সিনিয়র ফুটবলারদের এশিয়া কাপ, এপ্রিলে অনূর্ধ্ব-২০ এশিয়া কাপে খেলবে। তাই এবার কম্বিনেশন করা হয়েছে। আপাতত চলুক। কিন্তু এভাবে তো লিগ হয় না।’ কিরণ বললেন, ‘নারী ফুটবলটা আমার হাতে তুলেছি। আমার হাত দিয়ে ধ্বংস করতে পারব না।’
বাফুফের কর্মকর্তা সিরাজুল ইসলাম বাচ্চুর মৃত্যুর পর মহিলা ফুটবল পুনরায় ঢেলে সাজানোর পরিকল্পনা করা হয়। কাজী সালাহউদ্দিন এবং মাহফুজা আক্তার কিরণ, এ দুজনের কারণেই নারী ফুটবলের বর্তমান সাফল্যের গোড়াপত্তন। বাফুফে ভবনের চার তলায় পুরুষ জাতীয় ফুটবল দলের ক্যাম্প, আলফাজ-আরমানরা সেখানেই আবাসিক ক্যাম্প করতেন। পুরুষ ফুটবল দলের আবাসিক ক্যাম্পের জন্য পাঁচ তারকা হোটেলে পাঠানো হলো। নিশ্চিত নিরাপত্তার জন্য নারী ফুটবল দলকে তোলা হয়েছিল ফুটবল ভবনের ক্যাম্পে। সেই থেকে শুরু হলো নারী ফুটবল দলের আবাসিক ক্যাম্প। এর জন্য অনেক কটুকথা শুনতে হয়েছিল। কিন্তু থেমে যাননি সালাহউদ্দিন-কিরণরা।
নারী ফুটবল বন্ধ করতে বাফুফের একাধিক সদস্য এবং সহ-সভাপতি বিরোধিতা করেছিলেন। তাতেও ক্যাম্প বন্ধ হয়নি। ‘ওদের দিয়ে কিচ্ছু হবে না। পুরুষ ফুটবলাররাই পারছে না, আর এসব পিচ্ছি-পাচ্ছি মেয়েদের দিয়ে নারী ফুটবলের উন্নতি হবে না। অনর্থক টাকা খরচ করা। এদেরকে বাড়িয়ে পাঠিয়ে দিক। বিয়ে-সাদী করবে, ওটাই ভালো-এ সব কথা বারবার বলা হলেও কানে তোলেনি কেউ। নারী ফুটবলারদের নিয়ে কাজ করতে গিয়ে বাফুফের ভেতর থেকে বাধা বিপত্তি যেটাই এসেছিল, সে সব আমলে না নিয়ে ক্যাম্প চলেছে। খেলোয়াড়দের রুমে রুমে এসি, কাপড় ধোয়ার জন্য ওয়াশিং মেশিন, খেলোয়াড়দের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করতে পার্লারে পাঠানো, ভাতের পরিমাণ কমিয়ে অন্যান্য শক্তিশালী আধুনিক খাবারে অভ্যস্ত করে তোলা, সংবাদমাধ্যমে কথা বলা শেখানো, ইংরেজিতে কথা বলার পারদর্শিতা, ক্যাম্পের ভেতরে পড়ালেখার জন্য শিক্ষক রাখা, খেলার মান উন্নয়নে দেশি কোচের সঙ্গে বিদেশি কোচ আনা হয়।
ফিফার সঙ্গে কথা বলে খেলোয়াড়দেরকে বেতন কাঠামোয় অন্তর্ভুক্ত করা। বয়সভিত্তিক ফুটবলে একের পর এক সাফল্য আসতে আসতে সিনিয়র ফুটবলে সাফল্য এসেছে। নারী সাফে বাংলাদেশ পর পর দুই বার চ্যাম্পিয়ন। বাফুফেতে নতুন সভাপতি এলেন, তাবিথ আউয়াল। তিনি নারী ফুটবলে নতুন মাত্রা দেওয়ার চেষ্টা করলেও গুঞ্জন রয়েছে তার নাম দিয়ে একটা পক্ষ নারী ফুটবলের পরিকল্পনা নিয়ে টানাটানি করছে। দ্বিমুখী পরিকল্পনার কারণে ক্লাবগুলো বাফুফের ওপর বিরক্ত। একেক জন একেকটা পরিকল্পনার কথা বলবে। যার কাজ সে করলেই তো বাফুফে সমালোচনার মুখে পড়ে না।