
দীর্ঘদিন ধরেই রাজনৈতিক নিরপেক্ষতার নীতি ঘোষণা করে আসছে ফিফা। যার কারণে রাজনৈতিক বার্তা প্রদর্শনের জন্য মাঝে মধ্যেই ফুটবলের নিয়ন্ত্রক সংস্থার জরিমানা ও নিষিদ্ধজ্ঞার সম্মুখীন হন ফুটবলাররা।
তবে শুক্রবার (৫ ডিসেম্বর) ফিফা প্রধান জিয়ান্নি ইনফান্তিনো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে প্রথম ফিফা শান্তি পুরস্কার প্রদান করেছেন। এতে করে রিপাবলিকান নেতার প্রতি ইনফান্তিনোর আলিঙ্গনকে আরও দৃঢ় করে তোলে। এতে করে ফিফার নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে।
সমালোচকরা উল্লেখ করেছেন, পুরস্কার দেওয়ার ২৪ ঘণ্টারও কম সময় আগে ট্রাম্প প্রশাসন ক্যারিবিয়ান অঞ্চলে আরেকটি প্রাণঘাতী বিমান হামলা চালিয়েছে।
জাতিসংঘের সাবেক কর্মকর্তা ক্রেগ মোখিবার। যিনি গাজায় গণহত্যা দায়ে বিশ্ব ফুটবল থেকে ইসরায়েলকে নিষিদ্ধ করার জন্য প্রচারণা চলিয়েছিলেন। তিনি ট্রাম্পকে দেওয়ার ফিফার শান্তি পুরস্কারকে ‘লজ্জাজনক’ বলে উল্লেখ করেছেন।
ইনফান্তিনো ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে অস্বীকৃতি জানান। ফিফা প্রধান বলেছিলেন, ‘ফুটবল ভূ-রাজনৈতিক সমস্যা সমাধান করতে পারে না।’
মোখিবার আল জাজিরাকে বলেন, “ফিলিস্তিনে গণহত্যায় দুই বছর ধরে ফিফার সহযোগিতায় সন্তুষ্ট না হয়ে ইনফান্তিনো ও তার সঙ্গীরা এখন ট্রাম্পকে খুশি করতে নতুন একটি ‘শান্তি পুরস্কার’ উদ্ভাবন করেছেন।”
তিনি আরও বলেন, এই পুরস্কারের উদ্দেশ্য হলো ইসরায়েলকে ট্রাম্পের দৃঢ় সমর্থন, ক্যারিবীয় সাগরে প্রাণঘাতী হামলা এবং যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরে ‘গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন’—এসবকে আড়াল করা।
ট্রাম্পের প্রশংসায় পঞ্চমুখ ইনফান্তিনো
ফিফা শান্তি পুরস্কার প্রদানকালে ট্রাম্পের আন্তর্জাতিক চুক্তিগুলোর প্রশংসা করেন ইনফান্তিনো। যেমন ‘আব্রাহাম অ্যাকর্ডস’, যা ফিলিস্তিনের রাষ্ট্রীয় মর্যাদার প্রশ্ন সমাধান না করেই ইসরায়েল ও কয়েকটি আরব দেশের মধ্যে আনুষ্ঠানিক সম্পর্ক স্থাপন করে।
ইনফান্তিনো বলেন, “আমরা একজন নেতার থেকে এটি-ই চাই: এমন একজন নেতা, যিনি মানুষকে গুরুত্ব দেন। আমরা নিরাপদ পৃথিবীতে বাঁচতে চাই, নিরাপদ পরিবেশে থাকতে চাই। আমরা ঐক্য চাই, যা আমরা আজ এখানে করছি এবং বিশ্বকাপে সেটিই করতে চাই।”
ফিফা প্রধান আরও বলেন, “মিস্টার প্রেসিডেন্ট, আপনি অবশ্যই প্রথম ফিফা শান্তি পুরস্কারের যোগ্য—আপনার কাজের জন্য, আপনার সাফল্যের জন্য, যা আপনি সত্যিই অবিশ্বাস্যভাবে অর্জন করেছেন।”
ট্রাম্প বহুবার নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য প্রচারণা চালিয়েছেন। তবে চলতি বছরের শুরুর দিকে তিনি তা পাননি। ফিফার এই শান্তি পুরস্কারটিকে তার পাওয়া সবচেয়ে বড় সম্মানগুলোর একটি উল্লেখ করেছেন ট্রাম্প। এছাড়া লাখো মানুষের জীবন বাঁচিয়েছেন এবং আটটি যুদ্ধের অবসান ঘটিয়েছেন বলে দাবি করেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট।
আগের অবস্থান থেকে ফিফার সরে যাওয়া
ফিফা প্রেসিডেন্ট ইনফান্তিনো অতীতে ফুটবলকে বিভাজনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার না করার আহ্বান জানিয়েছিলেন। ২০২৩ সালে তিনি বলেছিলেন, মানুষকে একত্রিত করার জন্য খেলাধুলার মতো শক্তিশালী হাতিয়ার আর নেই। এখন আমাদের খেলাধুলার স্বায়ত্তশাসন রক্ষা করতে হবে, খেলাধুলার রাজনৈতিক নিরপেক্ষতা রক্ষা করতে হবে।
মাত্র দুই বছর পর সমালোচকরা বলছেন, ইনফান্তিনো একদিকে শান্তি ও ঐক্য উদযাপনের জন্য পুরস্কার তৈরি করেছেন, আবার সেই পুরস্কার তুলে দিয়েছেন এমন একজন প্রেসিডেন্টকে, যিনি কয়েকদিন আগেই সোমালিয়ার মানুষদের ‘আবর্জনা’ বলেছেন।
ফুটবল সাংবাদিক জ্যাক লোই সামাজিক মাধ্যমে লিখেছেন, “ডোনাল্ড ট্রাম্পকে শান্তির পুরস্কার দেওয়া ঠিক লুইস সুয়ারেজকে মানুষ না কামড়ানোর জন্য পুরস্কার দেওয়ার মতো।” উরুগুইয়ান ফরোয়ার্ড সুয়ারেজের ক্যারিয়ারের তিনটি কামড়ানোর ঘটনাকে ইঙ্গিত করেছেন এই সাংবাদিক।
ডেমোক্র্যাটিক পার্টি এই নতুন ফিফা পুরস্কারকে তীব্র সমালোচনা করেছে। তাদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম পোস্টে বলা হয়, “ট্রাম্প নোবেল শান্তি পুরস্কার জিততে পারেননি, তাই ফিফা তার জন্য একটা বানিয়ে ফেললো!”
ট্রাম্পের রেকর্ড
যদিও ট্রাম্প কিছু শান্তিচুক্তি মধ্যস্থতা করেছেন, সম্প্রতি রুয়ান্ডা ও কঙ্গোর মধ্যে। তিনি পশ্চিমা বিশ্বে সামরিক ব্যয় বাড়ানোর অন্যতম জোরালো সমর্থক।
ট্রাম্প জুন মাসে ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় বোমা হামলার নির্দেশ দেন এবং ইসরায়েল তার নথিভুক্ত মানবাধিকার লঙ্ঘন সত্ত্বেও তিনি দেশটিকে অস্ত্র সরবরাহ অব্যাহত রেখেছেন।
পশ্চিম গোলার্ধে তার প্রশাসন ২২টি বিমান হামলা চালিয়েছে কথিত মাদকবাহী নৌযানের ওপর, যাতে কমপক্ষে ৮৬ জন নিহত হয়েছে। আইন বিশেষজ্ঞরা এ সব হামলাকে অবৈধ বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড হিসেবে নিন্দা করেছেন।
এ ছাড়া, ভেনেজুয়েলার সীমানা ঘিরে যুক্তরাষ্ট্র সামরিক উপস্থিতি বাড়াচ্ছে, যা বামপন্থি প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরোকে ক্ষমতাচ্যুত করতে সম্ভাব্য যুদ্ধের গুঞ্জন তুলছে।
দেশের অভ্যন্তরে ট্রাম্প অভিবাসনবিরোধী অভিযানে কঠোরতা বাড়িয়েছেন, যার ফলে অনেককে আটক ও বহিষ্কারের চেষ্টা চলছে। ইসরায়েলের সমালোচনা করায় কিছু মানবাধিকারকর্মীকে লক্ষ্য করা হয়েছে, যা যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের প্রথম সংশোধনীতে সুরক্ষিত মতপ্রকাশের স্বাধীনতার অন্তর্ভুক্ত।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলেছে, ট্রাম্পকে সদ্য তৈরি করা ‘শান্তি পুরস্কার’ দিয়েছে ফিফা। কিন্তু তার প্রশাসনের ভয়াবহ মানবাধিকার রেকর্ড কোনোভাবেই শান্তি ও ঐক্যের অসাধারণ কাজ প্রদর্শন করে না।
পুরস্কার প্রত্যাহারের দাবি
জাতিসংঘের সাবেক কর্মকর্তা মোখিবার ফিফার এই শান্তি পুরস্কার প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছেন। তিনি বলেন, “এই অশ্লীল পুরস্কার অবশ্যই প্রত্যাহার করতে হবে। ফিফার নিয়ম অনুযায়ী কাদামাটির মাঠে খেলা যায় না। রক্তাক্ত মাঠে খেলার তো প্রশ্নই ওঠে না, কিন্তু ইনফান্তিনো ফিফাকে সেদিকেই নিয়ে যাচ্ছেন।”
সূত্র: আলজাজিরা