
দেশের অর্থনীতির রক্তক্ষরণ হচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজের (বিসিআই) সভাপতি আনোয়ার উল আলম চৌধুরী পারভেজ। তিনি বলেন, আমরা চিত্কার করলেও সরকার শুনছে না। তারা ব্যবসায়ী মহলকে কেয়ার করছে না। গতকাল বৃহস্পতিবার বনানীস্থ পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) কার্যালয়ে মাসিক অর্থনৈতিক পর্যালোচনা অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে এসব কথা বলেন তিনি। আনোয়ার উল আলম বলেন, বেসরকারি খাতে ব্যাংক ঋণ প্রবাহ ব্যাপকভাবে কমে গেছে। এমনকি যারা এখন ঋণ নিচ্ছেন, তারা মূলত অন্য ব্যাংক ঋণ পরিশোধ করতে নিচ্ছেন, যাতে সেই ঋণগুলো অনিয়মিত বা খেলাপি না হয়ে যায়। বিজিএমইএ-এর সাবেক এই সভপতি অভিযোগ করে বলেন, অর্থনীতির রক্তক্ষরণ হচ্ছে। সরকার কি শুনছে? দুঃখজনকভাবে ব্যবসায়ীদের কথায় তাদের কোনো আগ্রহ নেই।
সেপ্টেম্বর-অক্টোবরের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আয়োজিত সেমিনারে সভাপতিত্ব করেন পিআরআইয়ের চেয়ারম্যান ড. জাইদী সাত্তার। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সংস্থাটির প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. আশিকুর রহমান।
আনোয়ার উল আলম চৌধুরী পারভেজ বলেন, সরকার জ্বালানির দাম বাড়িয়েও সরবরাহ নিশ্চিত করতে পারছে না। ২০২২ সালের পর থেকেই জ্বালানির সংকটে উত্পাদন ব্যাহত হচ্ছে। প্রায় ৫০ শতাংশ ক্ষুদ্র প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। সবাই ঢাকায় এসে ‘টেসলা’ (অটোরিকশা) চালাচ্ছে। এই শহরের জনসংখ্যা এখন সাড়ে ৩ কোটি হয়ে গেছে। খেলাপি ঋণ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ১৭ শতাংশ খেলাপি ঋণ থাকার সময় আইএমএফ বাংলাদেশকে মধ্যম মানের ঝুঁকিপূর্ণ বলেছিল। এখন তা ৩৫ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। তার প্রশ্ন, আইএমএফ এখন বাংলাদেশের খেলাপি ঋণকে কোন মানের আখ্যা দেবে। আগে ঋণ পুনঃ তপশিল করতে ঋণগ্রহীতাদের ছয় মাস সময় দেওয়া হতো। কিন্তু এই সময় কমিয়ে তিন মাস করা হচ্ছে। তিনি মনে করেন, এই নীতি খেলাপি ঋণ আরো বাড়িয়ে দেবে।
পিআরআইয়ের চেয়ারম্যান ড. জাইদী সাত্তার বলেন, মে মাস থেকে রিয়েল ইফেক্টিভ এক্সচেঞ্জ রেট (আরইইআর) সূচক বৃদ্ধি পেয়েছে, এটি রপ্তানিকারকদের জন্য উদ্বেগের কারণ হওয়া উচিত। বাংলাদেশ ব্যাংক এখন আর বাজার থেকে ডলার ক্রয় করে টাকার অবমূল্যায়ন ঘটাতে পারে না, ফলে আমদানি নিষেধাজ্ঞা শিথিল করাই একমাত্র বাস্তবসম্মত পথ, যা রপ্তানিকারকদেরও সহায়তা করবে। অধিকতর সক্রিয় আমদানি প্রবাহ নমনীয় বিনিময় হার ব্যবস্থাপনায় সহায়ক ভূমিকা রাখবে এবং রপ্তানি পরিবেশকে আরো গতিশীল করবে।
তিনি বলেন, অর্থনীতির গতি কমলেও স্থিতিশীলতা এসেছে। কর্মসংস্থান বাড়াতে আরো উদার নীতি গ্রহণ করতে হবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পালটা শুল্কের প্রভাবে রপ্তানি কিছুটা কমলেও বাংলাদেশ এ ক্ষেত্রে এখনো ভারত ও পাকিস্তানের চেয়ে ভালো অবস্থানে আছে বলে মনে করছেন তিনি।
মূল প্রবন্ধে অর্থনীতিবিদ ড. আশিকুর রহমান বলেন, কঠিন পদক্ষেপ না নিলে উচ্চ খেলাপি ঋণের কারণে দেশের অর্থনীতিতে মধ্যমেয়াদি ঝুঁকি তৈরি হবে। এতে দেশের বর্তমান ও ভবিষ্যত্ প্রজন্মের সম্ভাবনা সংকুচিত হতে পারে। কীভাবে এই খেলাপি ঋণ ব্যবস্থাপনা করা হবে, সেটাই বড় চ্যালেঞ্জ । তিনি বলেন, আধুনিক ইতিহাসের সবচেয়ে কঠিন সময় পার করছে দেশের অর্থনীতি। বাংলাদেশের অধিকাংশ খেলাপি ঋণের ক্ষেত্রে কার্যকর জামানত নেই, ফলে প্রকৃত বাজারমূল্যায়ন জটিল হয়ে দাঁড়ায়। এতে পুরো সমাধান প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হতে পারে।
তিনি আরো বলেন, আর্থিক খাতে আনুমানিক ৬.৪ লাখ কোটি টাকার অনাদায়ী ঋণ বহাল থাকা সামগ্রিক অর্থনীতির ওপর গভীর চাপ সৃষ্টি করছে। এত বিপুল পরিমাণ খারাপ ঋণের কারণে ব্যাংকগুলোকে উচ্চ সুদহার বজায় রাখতে হয়, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তারল্য সহায়তার ওপর নির্ভর করতে হয় এবং উত্পাদনশীল খাতে ঋণপ্রবাহ কমে যায়। এর ফল হলো একটি ‘বিষাক্ত চক্র’, অর্থাত্ বিনিয়োগ কমে, মূল্যস্ফীতি বাড়ে, প্রবৃদ্ধি দুর্বল হয়। তিনি সতর্ক করেন, খেলাপি ঋণ সংকট সঠিকভাবে মোকাবিলা করা না গেলে দেশ ‘উচ্চ সুদহার, উচ্চ মূল্যস্ফীতি, নিম্ন বিনিয়োগ, নিম্ন প্রবৃদ্ধির’ ফাঁদে আটকে পড়তে পারে। এটি আর শুধু ব্যাংক খাতের সমস্যা নয়, এটি একটি সামষ্টিক অর্থনৈতিক বাধ্যবাধকতা।
বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে পুনর্গঠিত, পুনঃ তপশিলকৃত ও খেলাপি ঋণসহ মোট ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদের পরিমাণ এখন প্রায় সাড়ে ৯ লাখ কোটি টাকাতে দাঁড়াতে পারে বলে ধারণা দিয়েছে গবেষণা সংস্থা পিআরআই। সেমিনারে প্যানেল আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান ড. নাসিরউদ্দিন আহমেদ, নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ড. এ কে এম আতিউর রহমান, বিল্ড-এর রিসার্চ ডিরেক্টর ড. ওয়াসেল বিন সাদাত এবং পিকার্ড বাংলাদেশের ডিএমডি আমৃতা মাকিন ইসলাম।
ড. ওয়াসেল মন্তব্য করেন, সত্ করদাতারা শাস্তির মুখে পড়ছেন, যা করনীতির ন্যায়বিচারের পরিপন্থি। এ কারণেই অর্থনীতির প্রায় ৮৫ শতাংশ এখনো অনানুষ্ঠানিক খাতে রয়ে গেছে। পাশাপাশি রাজনৈতিক দলগুলোর ইশতেহারগুলো অর্থনীতির বাস্তব পরিস্থিতিকে যথাযথ গুরুত্ব দেয় না।
ড. নাসিরউদ্দিন আহমেদ মনে করেন, করনীতি প্রণয়ন করা উচিত রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ী মহলের মাধ্যমে আমলাদের মাধ্যমে নয়, যাদের কেউ কেউ নীতিকাঠামোর দুর্বলতার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছেন। তিনি কর্মসংস্থান ঘাটতি এবং মানসম্মত, দক্ষতাভিত্তিক শিক্ষার অভাবকে পরবর্তী সরকারের প্রধান অগ্রাধিকার হওয়া উচিত বলে উল্লেখ করেন। ড. আতিউর রহমান বলেন, জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থান না হলে খেলাপি ঋণ-সংকটের প্রকৃত মাত্রা আড়ালেই থেকে যেত।