
চলতি বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা ৬৯ হাজার ৩৬৫ জন। আর মৃত্যু হয়েছে ২৭৮ জনের। অন্য বছরগুলোতে এই সময়ে ডেঙ্গুর মৌসুম শেষ হয়ে কিছুটা স্বস্তিতে থাকার কথা থাকলেও, এ বছর অক্টোবরেও সে আশায় গুড়েবালি। এ বছর শুধু অক্টোবরে আক্রান্ত ২২ হাজার ১৪ জন ও মৃত্যু ৮০ জনের-দুইয়েই বছরের শীর্ষে অবস্থান করছে মাসটি। এখন পর্যন্ত ডেঙ্গু ছড়িয়েছে ৬৩টি দেশের জেলায়। এখনো যে হারে হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হচ্ছে, তাতে চিকিৎসকরা বলছেন-এমন সংক্রমণ চলতে পারে নভেম্বর-ডিসেম্বর কিংবা শীত মৌসুম জুড়েই। এখন আর ডেঙ্গুর আলাদা কোনো মৌসুম নেই। তাই সচেতন থাকতে হবে বছরব্যাপী যদি না আমরা এডিস মশা নিয়ন্ত্রণ করতে পারি। কিন্তু আমাদের দেশে মশা নিধনের যে প্রচেষ্টা-তা ডেঙ্গুর বিস্তারের তুলনায় নগণ্য।
এদিকে কীটতত্ত্ববিদ ও জনস্বাস্থ্যবিদরা বলছেন, আগামী নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসেও দেশে ডেঙ্গুর প্রকোপ কমবে না, এ বছর ডেঙ্গুর সিজন বলেও কিছু থাকছে না। শীতকালেও থাকবে এডিস মশার দাপট এবং বাড়বে ডেঙ্গুর ব্যাপকতা। শুধু তাই নয়, চলতি বছরের সংক্রমণ ধারাবাহিকভাবে
চলতে পারে আগামী বছরও।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক (রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখা) ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. বেনজির আহমেদ ইত্তেফাককে বলেন, ‘ডেঙ্গু এবার সারা বছর থাকবে, যেটা আগে হতো না। ইদানীংকালে সেই প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। এবার সেটা প্রতিষ্ঠিত হলো-অক্টোবরে সর্বোচ্চ আক্রান্ত এবং মৃত্যু। হয়তো নভেম্বরেও এমনটাই হতে পারে।
এই জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ আরো বলেন, এবার ডেঙ্গুর আরেকটা প্রবণতা ছিল, তা হলো গ্রামাঞ্চলগুলোতে, ছোট ছোট শহরগুলোতে ডেঙ্গুর প্রবণতা বেড়েছে; এটা নতুন একটা ডায়মেনশন। এ থেকে আমাদের একটা শঙ্কার দিক তৈরি হলো যে, আগামী ৩০/৪০ বছর হয়তো গ্রামগুলো ডেঙ্গুর প্রকোপে জর্জরিত হবে। দ্বিতীয় হচ্ছে-স্বাস্থ্যসেবা; ডেঙ্গু শনাক্তকরণ এবং চিকিৎসা দুটোই রাজধানীকেন্দ্রিক। বড় বড় শহরগুলোতেও ডেঙ্গুর চিকিৎসা অত্যন্ত দুর্বল। যার ফলে ডেঙ্গু চিকিৎসাটা ঠিকমতো হবে না এবং মৃত্যুর শঙ্কা বাড়বে।
তৃতীয়ত, আমাদের গ্রামের মানুষের আর্থসামাজিক অবস্থা যেহেতু একটু দুর্বল সুতরাং একেক জন ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসা করাতে গিয়ে একেকটা পরিবার সর্বস্বান্ত হবে-এটা নিয়ে আমরা শঙ্কিত। গ্রামাঞ্চলে ডেঙ্গু একটা বিশেষ জনস্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে দেখা দেবে।
তিনি বলেন, ‘আরেকটা দুঃখের কথা হলো-এই মাসেও ডেঙ্গুতে এত আক্রান্ত হলো, মৃত্যু হলো, কিন্তু সেটা নিয়ে আমাদের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে বড় কোনো উদ্যোগ নিতে দেখা গেল না। এত রোগীর মৃত্যুর পরেও এত ভাবলেশহীন থাকাটা দুঃখজনক। অধ্যাপক বেনজির বলেন, আমাদের মূল মনোযোগ দিতে হবে মশা নিয়ন্ত্রণের দিকে; ডেঙ্গু শনাক্তকরণ এবং চিকিৎসার দিকে। তা না হলে সামনের দিনগুলোতে আমাদের অনেক মানুষের জীবন ঝুঁকির মুখে পড়বে।
একই কথা বললেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও মশাবাহিত রোগবিষয়ক গবেষক কীটতত্ত্ববিদ ড. কবিরুল বাশার। তিনি ইত্তেফাককে বলেন, গতকালও বৃষ্টি হয়েছে। এ বছর ডেঙ্গুর সিজন দীর্ঘ হবে। সাধারণত নভেম্বরে ডেঙ্গু থাকে না। কিন্তু এ বছর তা আর হবে না। এ বছর ডেঙ্গুর সিজন বলে আর কিছু থাকল না, নভেম্বর-ডিসেম্বরেও ডেঙ্গুর প্রকোপ থাকবে। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, আমরা সচেতনতা বাড়ানোর কথা বললেও তো কর্তৃপক্ষ শোনেন না।
গতকাল বৃহস্পতিবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম থেকে
পাঠানো ডেঙ্গু বিষয়ক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত ২৪ ঘণ্টায় (বুধবার সকাল ৮টা থেকে বৃহস্পতিবার সকাল ৮টা পর্যন্ত) ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে ৯২৮ জন। এই সময় ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয়েছে তিন জনের।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, এডিস মশাবাহিত এ রোগে অক্টোবরে এ পর্যন্ত হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে ২২ হাজার ১৪ জন, মৃত্যু হয়েছে ৮০ জনের। আক্রান্ত ও মৃত্যুর এই হিসাব ১০ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ। এর আগে সেপ্টেম্বরে ৭৬ জনের প্রাণ কেড়েছে ডেঙ্গু। সে মাসে ১৫ হাজার ৮৬৬ জন হাসপাতালে ভর্তি হন।