
ফুটবল মাঠের নিয়ন্ত্রক তারাই, অথচ তারাই নাকি বাজির টানে নিজের নিরপেক্ষতার সীমা ভেঙেছেন—তুরস্কে এমন এক কেলেঙ্কারির খবর এখন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। দেশটির ফুটবল ফেডারেশন জানিয়েছে, পেশাদার লিগে দায়িত্বে থাকা ৫৭১ রেফারির মধ্যে ৩৭১ জনেরই রয়েছে ব্যক্তিগত বেটিং অ্যাকাউন্ট। এর মধ্যে ১৫২ জন রেফারি সক্রিয়ভাবে বাজিতে অংশ নিয়েছেন। এই চাঞ্চল্যকর তথ্য সামনে আসতেই ইস্তাম্বুলের প্রসিকিউটর অফিস ম্যাচ ফিক্সিংয়ের অভিযোগে আনুষ্ঠানিক তদন্ত শুরু করেছে।
তুরস্ক ফুটবল ফেডারেশন (টিএফএফ)-এর সভাপতি ইব্রাহিম হাজিওসমানগ্লু সোমবার জানিয়েছেন, রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষের সহায়তায় পরিচালিত তদন্তে রেফারিদের মধ্যকার এক ব্যাপক বাজি নেটওয়ার্কের হদিস মিলেছে। তদন্তে দেখা গেছে, বাজিতে জড়িতদের মধ্যে সাতজন শীর্ষ পর্যায়ের রেফারি এবং ১৫ জন সহকারী রেফারি রয়েছেন।
আরও অবাক করার বিষয়, একজন রেফারি ১৮ হাজার ২২৭ বার বাজি ধরেছেন, আর ৪২ জন রেফারি এক হাজারেরও বেশি ম্যাচে বাজি রেখেছেন। হাজিওসমানগ্লু বলেন, ‘আজ থেকেই আমরা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে যাচ্ছি। অভিযুক্ত রেফারিদের শৃঙ্খলা বোর্ডে পাঠানো হবে এবং আমাদের নিয়ম অনুযায়ী তারা শাস্তির মুখোমুখি হবেন।’
ইস্তাম্বুলের প্রধান পাবলিক প্রসিকিউটর অফিস জানিয়েছে, হাজিওসমানগ্লুর এই বক্তব্যকে তারা আনুষ্ঠানিক অভিযোগ হিসেবে গ্রহণ করেছে এবং চলমান তদন্ত আরও সম্প্রসারিত হবে। প্রসিকিউটররা তুরস্কের ক্রীড়া আইন, ফেডারেশন বিধি এবং বাজি সংক্রান্ত আইনের সম্ভাব্য লঙ্ঘনের বিষয়গুলো খতিয়ে দেখছেন। তদন্তটি ২০২৪ সালের এপ্রিলে শুরু হয় এবং এখন সেটি নতুনভাবে গভীর পর্যায়ে পৌঁছেছে। প্রসিকিউটর অফিসের ভাষায়, ‘অভিযুক্ত রেফারিদের সনাক্ত করা হয়েছে, এখন তদন্ত আরও বিস্তৃত করা হবে।’
ঘটনাটি প্রকাশ্যে আসতেই তুরস্কের বড় ক্লাবগুলো একের পর এক প্রতিক্রিয়া জানাতে শুরু করেছে। গ্যালাটাসারায়ের সভাপতি দুরসুন ওজবেক এটিকে ‘তুরস্ক ফুটবলের জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ মোড়’ বলে মন্তব্য করেছেন। তিনি ফেডারেশনের কাছে দাবি করেছেন, বাজিতে জড়িত রেফারিদের নাম, তারা কোন ম্যাচে দায়িত্ব পালন করেছেন এবং কোন কোন ম্যাচে বাজি ধরেছেন—এসব বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ করতে হবে।
‘আমরা এই প্রক্রিয়াটি শেষ পর্যন্ত অনুসরণ করব,’ ক্লাবের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত বিবৃতিতে বলেন ওজবেক। ‘তুরস্কি ফুটবলের অন্ধকার দিকগুলো উন্মোচনের জন্য প্রয়োজনীয় সব দায়িত্ব নিতে আমরা প্রস্তুত।’
ফেনারবাহচের সভাপতি সাদেত্তিন সারান বলেন, ‘আমাদের অভিযোগের সত্যতা অবশেষে প্রমাণিত হচ্ছে।’ তিনি ব্যক্তিগতভাবে তদন্তের অগ্রগতি পর্যবেক্ষণের অঙ্গীকারও করেছেন। অন্যদিকে বেসিকতাস রেফারিদের নাম প্রকাশের দাবি জানিয়েছে, এবং কিছু ক্লাব চলতি মৌসুমে অবনমন (রিলিগেশন) বাতিল করারও আহ্বান জানাচ্ছে।
টিএফএফের শৃঙ্খলাবিধির ৫৭ নম্বর অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, ফুটবল ম্যাচে বাজি ধরার অপরাধে দোষী প্রমাণিত রেফারিদের তিন মাস থেকে এক বছর পর্যন্ত রেফারিং বা ফুটবল-সংক্রান্ত যেকোনো কর্মকাণ্ড থেকে নিষিদ্ধ করা হতে পারে।
ফেডারেশন জানিয়েছে, তদন্তে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে শৃঙ্খলা কমিটি দ্রুত কার্যক্রম শুরু করবে এবং সংশ্লিষ্ট সব রেফারিকে তদন্ত প্রক্রিয়ার আওতায় আনা হবে। এই অভ্যন্তরীণ ঝড় এখন তুরস্কের ফুটবলে দীর্ঘদিন ধরে চলা ম্যাচ ফিক্সিং ও দুর্নীতির অভিযোগগুলোকে নতুন করে সামনে নিয়ে এসেছে।
তুরস্কের পেশাদার ফুটবলে ম্যাচ ফিক্সিং ও দুর্নীতির অভিযোগ নতুন নয়। কিন্তু এত বড় পরিসরে রেফারিদের বাজিতে জড়িত থাকার প্রমাণ এটাই প্রথম, যা দেশটির ফুটবল প্রশাসন ও ন্যায়পরায়ণতা—দুটোকেই কঠিন পরীক্ষার মুখে ফেলেছে।