
বিশ্বজুড়ে অর্থনৈতিক অস্থিরতা ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর আগ্রাসী কেনাকাটার প্রভাবে আকাশছোঁয়া হয়েছে স্বর্ণের দাম। বাংলাদেশের বাজারেও এর প্রভাব পড়েছে প্রবলভাবে। এক ভরি স্বর্ণের দাম এখন ২ লাখ ১৬ হাজার টাকায় পৌঁছেছে, যা দুই বছর আগের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ। এতে সাধারণ ক্রেতারা বিপাকে পড়লেও অনেকে ভবিষ্যতে আরও দাম বাড়ার আশায় এখনই স্বর্ণ কিনে রাখছেন।
বাজুসের সহ-সভাপতি মাসুদুর রহমান বলেন, ‘যারা আগে ২–৫ হাজার টাকার গহনা কিনতেন, তারা এখন পুরোপুরি কেনা বন্ধ করেছেন।’
বিশ্ববাজারের দিকেও তাকালে দেখা যায়, প্রতি আউন্স স্বর্ণের দাম ইতোমধ্যে ৪ হাজার ডলার ছাড়িয়েছে। রয়টার্স জানিয়েছে, শুধু ২০২৫ সালেই বিশ্ববাজারে স্বর্ণের দাম বেড়েছে ৫৪ শতাংশ। বিশ্লেষকদের মতে, রাজনৈতিক অস্থিরতা, ইউরোপের মন্থর অর্থনীতি ও ডলারের দুর্বল অবস্থান এই বৃদ্ধির মূল কারণ।
ফরাসি বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান সোসিয়েতে জেনেরালের বিশ্লেষকরা বলছেন, বড় প্রতিষ্ঠানগুলোর বিনিয়োগ বাড়তে থাকায় খুব শিগগিরই প্রতি আউন্স স্বর্ণের দাম ৫ হাজার ডলার ছুঁতে পারে। কারণ, ডলারের মান যত কমছে, ততই বাড়ছে স্বর্ণের চাহিদা।
ওয়ার্ল্ড গোল্ড কাউন্সিলের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের মাঝামাঝি বিশ্বের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো (যুক্তরাষ্ট্র বাদে) মজুদে ২৯ হাজার ৯৯৮ টন স্বর্ণ রেখেছে—যার মূল্য ৩ দশমিক ৯৩ ট্রিলিয়ন ডলার। ১০ বছর আগে রিজার্ভে স্বর্ণের অংশ ছিল মাত্র ১০ শতাংশ, এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৪ শতাংশে।
বাংলাদেশের রিজার্ভে এখন রয়েছে ১৪ দশমিক ২৮ টন স্বর্ণ; তুলনায় পাকিস্তানের ৬৪ দশমিক ৭৫ টন ও ভারতের ৮৭৯ দশমিক ৯৮ টন।
দেশীয় বাজারে দাম বাড়ার পেছনে বৈশ্বিক প্রভাব ছাড়াও রয়েছে দীর্ঘদিনের অনিয়ম ও সীমিত আমদানি। বাজুসের তথ্য অনুযায়ী, দেশে বছরে প্রায় ৪০ টন স্বর্ণের চাহিদা থাকলেও এর ৮০ শতাংশই আসে ‘পাচারের’ মাধ্যমে। গত পাঁচ বছরে ২১টি অনুমোদিত আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান মিলে আমদানি করেছে মাত্র ১ টন স্বর্ণ।
বৈধ আমদানি সীমিত থাকায় ব্যাগেজ নীতির আওতায় আনা স্বর্ণই এখন বাজারের মূল উৎস। তাছাড়া টাকার মান ডলারের তুলনায় কমে যাওয়ায় দাম আরও বেড়েছে। ২০১৮ সালে প্রথমবার এক ভরি স্বর্ণের দাম ৫০ হাজার টাকা ছাড়ায়; ২০২৩ সালে তা হয় ১ লাখ, ২০২৫ সালের শুরুতে ১ লাখ ৫০ হাজার, আর এখন তা ২ লাখ টাকার ওপরে।
বাজুসের মুখপাত্র মাসুদুর রহমান বলেন, ‘অনেকে জানেন, বিশ্ববাজারে দাম আরও বাড়ছে। তাই তারা বিক্রি না করে ধরে রাখছেন।’ তার মতে, বাংলাদেশ ব্যাংক সরাসরি স্বর্ণ আমদানি শুরু করলে বাজারে স্বচ্ছতা ও স্থিতিশীলতা ফিরবে।
‘গোল্ড কিনেন’ স্টার্টআপের প্রধান অর্থ কর্মকর্তা আতেফ হাসান বলেন, ‘স্বর্ণের দামের এই উল্লম্ফন আসলে বিশ্ববাজারের বড় পরিবর্তনের প্রতিফলন।’ তার ভাষায়, ‘ইতিহাস আবারও প্রমাণ করছে, অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার সময়ে স্বর্ণই সবচেয়ে টেকসই ও নির্ভরযোগ্য সম্পদ।’
তিনি জানান, শুধু ২০২৫ সালেই বাংলাদেশে স্বর্ণের দাম প্রায় ৫৬ শতাংশ বেড়েছে, যা ধাতুটির প্রতি মানুষের যে বিশেষ আকর্ষণ রয়েছে সেটি প্রমাণ করে।
তিনি বলেন, গ্রাহকদের মধ্যে স্বর্ণের বার ও কয়েন কেনার আগ্রহ কিছুটা বেড়েছে, বিশেষ করে তাদের নতুন চালু করা ০.৫ গ্রামের স্বর্ণের বারটি বেশ জনপ্রিয় হচ্ছে। আতেফ হাসানের মতে, এখন স্বর্ণ শুধু অলংকার নয়, বরং একটি নির্ভরযোগ্য বিনিয়োগ।
বাজার বিশ্লেষকদের মতে, ক্রেতারা এখন দুই ভাগে বিভক্ত—একদল বাধ্য হয়ে স্বর্ণ বিক্রি করছেন, অন্যদল ভবিষ্যতে আরও দাম বাড়বে এই আশায় কিনে রাখছেন। ফলে এই মূল্যবান ধাতুর ঊর্ধ্বগতি শুধু কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভেই প্রভাব ফেলছে না, বরং ঢাকাসহ সারাদেশের পারিবারিক সংস্কৃতিতেও নতুন বাস্তবতা তৈরি করছে।