
অধিকৃত পশ্চিম তীরের দক্ষিণে মাসাফার ইয়াত্তার ছোট গ্রাম খাল্লেত আল-ডাবা। মে মাসের এক সকালে হঠাৎ গ্রামটির শান্ত পরিবেশ কেঁপে ওঠে বুলডোজার ও অন্যান্য যন্ত্রের গর্জনে। সঙ্গে ছিল ইসরায়েলের সেনারা। তারা দলে দলে গ্রামবাসীকে ঘর থেকে বের করে দেয়। গবাদি পশুদেরও খোলা মাঠে ছেড়ে দেওয়া হয়।
ঘটনাটি ঘটে ৫ মে। একদিনের মধ্যেই খাল্লেত আল-ডাবার ফিলিস্তিনিদের ছোট একটি সম্প্রদায়ের ঘরবাড়ি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। আলজাজিরার বিশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চলতি বছরে অধিকৃত পশ্চিম তীরে ইসরায়েলি বাহিনী এমন চারটি ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে। স্থানীয়রা এটিকে ‘নতুন নাকবা’ বলে অভিহিত করছেন—১৯৪৮ সালের নাকবার পুনরাবৃত্তি, যখন ইসরায়েলের হামলায় ব্যাপকভাবে ফিলিস্তিনিদের বাস্তুচ্যুতি ও জাতিগত নির্মূল হয়েছিল।
স্থানীয় ফিলিস্তিনিরা জানাচ্ছেন, ধ্বংসযজ্ঞ চলাকালীন কয়েক ডজন সেনা, সাঁজোয়া যান ও জিপ গ্রামটি ঘিরে রাখে। পরিবারগুলো—নারী, শিশুসহ—ঘন্টা ঘন্টা জ্বলন্ত সূর্যের নিচে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। চোখের সামনে তাদের ঘর ও পেছনের দেয়াল ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়।
বাস্তুচ্যুত পরিবারগুলো এখন নতুন জীবনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলার চেষ্টা করছে। কেউ কয়েক বছর আগে খনন করা গুহায় আশ্রয় নিয়েছেন, অন্যরা নাজুক তাঁবুতে থাকতে বাধ্য। শীত ও গ্রীষ্ম উভয়কালে এই তাঁবুতে থাকা এক কঠিন বাস্তবতা। পার্শ্ববর্তী আত-তুবানি গ্রামের কাউন্সিল প্রধান মোহাম্মদ রাবিয়া বলেন, ‘এ ঘটনায় খাল্লেত আল-ডাবার মানুষের জীবনের সব মৌলিক সুবিধা—পানি, বিদ্যুৎ, সৌরশক্তি, পানির কূপ, আবর্জনার পাত্র, এমনকি রাস্তার বাতি—সবই ধ্বংস হয়েছে। আমরা প্রায় প্রস্তরযুগে ফিরে গিয়েছি। তবু কেউ গ্রাম ছেড়ে যায়নি।’
সামরিক প্রশিক্ষণ এলাকা ও স্থানান্তর নীতি
খাল্লেত আল-ডাবা পাহাড় ঘেরা ১২টি ফিলিস্তিনি গ্রামের একটি। জাতিসংঘের পূর্ব প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মাসাফার ইয়াত্তায় এক হাজার ১৫০ জনের বাস। তবে স্থানীয়রা জানান, বাস্তবে এখানে প্রায় সাড়ে চার হাজার ফিলিস্তিনি বাস করেন। তারা মূলত ভেড়া পালন ও গম ও বার্লি চাষ করেন, যা তাদের আয়ের প্রধান উৎস।
পশ্চিম তীরের প্রায় ২০ শতাংশ ভূমির মতোই ইসরায়েল ১৯৮০-এর দশকে এই এলাকার একটি অংশকে সামরিক প্রশিক্ষণ এলাকা ‘ফায়ারিং জোন ৯১৮’ হিসেবে ঘোষণা করে। এরপর থেকে স্থানীয় ফিলিস্তিনিদের জোরপূর্বক স্থানান্তরের চেষ্টা শুরু হয়। ইসরায়েলি-ফিলিস্তিনি গবেষণা সংস্থা আকেভট জানায়, ১৯৮১ সালে তখনকার কৃষিমন্ত্রী অ্যারিয়েল শ্যারনের প্রস্তাবে এই এলাকা সামরিক প্রশিক্ষণ অঞ্চলে পরিণত হয়। পরে তিনি ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী হন।
খাল্লেত আল-ডাবার বাড়িঘর বারবার সামরিক আদেশে ধ্বংস করা হয়েছে। স্থানীয়রা বলছেন, অনুমতি ছাড়া নির্মাণ, সামরিক এলাকা সংলগ্ন অবস্থান বা অবৈধ ইহুদি বসতি স্থাপন—সবকিছুর মূল লক্ষ্য একটাই, ফিলিস্তিনিদের জোরপূর্বক স্থানান্তর করা।
ডক্টরস উইদাউট বর্ডারসের (এমএসএফ) ব্যবস্থাপক ফ্রেডেরিক ভ্যান ডোঙ্গেন বলেন, ‘মাসাফার ইয়াত্তায় ইসরায়েলের কর্মকাণ্ড বৃহত্তর পরিসরে জাতিগত নির্মূল নীতির অংশ। এর লক্ষ্য ফিলিস্তিনিদের এই এলাকা থেকে সরানো।’
গুহা ধ্বংসের দৃশ্য
৬৫ বছর বয়সী সামিহা মুহাম্মদ আল-ডাবাবসেহ, জন্ম থেকে খাল্লেত আল-ডাবার বাসিন্দা, ধ্বংসযজ্ঞের প্রত্যক্ষদর্শী। তিনি বলেন, ‘কয়েক মিনিটের মধ্যে সেনারা আমাদের ঘর থেকে জোরপূর্বক বের করে দেয়। কিছু নেয়ার অনুমতি দেয়নি—না খাবার, না কাপড়। তারা আমাকে ধাক্কা দিয়ে বলে, এটি তোমার জমি নয়; এখানে তোমার ঘর বা ঠিকানা থাকবে না।’
ঘর ধ্বংস হওয়ার পর সামিহা ও তার পরিবার একটি গুহায় আশ্রয় নেন, যা তারা নিজেই খুঁড়ে বানিয়েছিলেন। নারী ও শিশুদের ঘুম গুহার ভিতরে, পুরুষরা বাইরে মাটিতে থাকতেন। তবে গত ১৭ সেপ্টেম্বর সেই গুহাটিও ইসরায়েলি বাহিনী ধ্বংস করে দেয়।