
আফগানিস্তানের বিপক্ষে সিরিজ হার-আরেকটি পুরোনো কাহিনীর নতুন অধ্যায়। এক দিনের ক্রিকেটে নিজেদের ‘পুনর্জাগরণ’ খুঁজতে নামা বাংলাদেশ দল আবারও একই ভুলে ধরা দিয়েছে। ব্যাটিং বিপর্যয়, মানসিক দুর্বলতা এবং দায়িত্বজ্ঞানহীন শট নির্বাচনের পুনরাবৃত্তি যেন এখন অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। তবু দায়টা নিজেদের না দিয়ে এবার তা চাপানো হলো ফরম্যাটের ঘাড়ে, যেন সেটাই সব ব্যর্থতার একমাত্র কারণ।
স্পিন কোচ মুশতাক আহমেদের যুক্তি, টি-টোয়েন্টি থেকে ওয়ানডেতে ফেরায় ব্যাটাররা মানিয়ে নিতে পারেনি। এই অজুহাত নতুন নয়। বাংলাদেশ দল প্রায় প্রতিটি সিরিজে ফরম্যাট পরিবর্তনের দোহাই দেয়, অথচ আসল সমস্যা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। টেকনিক্যাল ঘাটতি, মানসিক ভঙ্গুরতা আর পরিকল্পনার অভাব-এই তিনটি কারণেই বারবার একই জায়গায় ফিরে আসছে দলটি।
রশিদ খানকে খেলতে না পারা যেন বাংলাদেশের জন্য চিরচেনা যন্ত্রণা। প্রতিবারই পরিকল্পনা হয়, আলোচনা হয়, কিন্তু বাস্তবে দেখা যায় পুরোনো আতঙ্ক। মুশতাক নিজেই স্বীকার করেছেন, ব্যাটাররা বল খেলছে না, খেলছে রশিদকে। অর্থাৎ উইকেটে বলের মুভমেন্ট নয়, বরং নামের ভারেই ভেঙে পড়ছে বাংলাদেশের টপ অর্ডার। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে মানসিক দৃঢ়তা যেখানে সবচেয়ে জরুরি, সেখানে বাংলাদেশের ব্যাটাররা এখনো ভয় আর চাপের সঙ্গে যুদ্ধ করে হেরে যাচ্ছে।
দলের আরেকটি বড় সমস্যা হলো দায়িত্ববোধের অভাব। মেহেদী হাসান মিরাজ স্বীকার করেছেন, ব্যাটাররা যথেষ্ট দায়িত্ব নিচ্ছে না। এ স্বীকারোক্তি শুনতে নতুন লাগলেও, এটি বাংলাদেশের ব্যাটিং সংস্কৃতির পুরোনো প্রতিচ্ছবি। দলীয় পরিকল্পনায় ‘অ্যাংকর’ হিসেবে কেউ টিকে থাকতে পারে না, মধ্যপথে এসে শট খেলতে গিয়ে নিজের উইকেট বিলিয়ে দেয়। জুটি গড়ে, কিন্তু সেটিকে বড় করতে পারে না। এই জায়গায় ক্রিকেটীয় বুদ্ধিমত্তার ঘাটতি স্পষ্ট।
বাংলাদেশের ব্যাটিং এখন এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, ২০০ রানের নিচের লক্ষ্যও চাপের পাহাড় হয়ে দাঁড়ায়। অথচ এটি এমন এক দল, যাদের ব্যাটিং একসময় ছিল স্থিতিশীলতার প্রতীক। তামিম, সাকিব, মুশফিক, মাহমুদউল্লাহদের সময়ের সেই অভিজ্ঞতা আজ হারিয়ে গেছে অমনোযোগ, অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তায়। নতুন প্রজন্মের ব্যাটারদের মধ্যে কেউই এখনো নিয়মিত পারফরম্যান্স দিয়ে জায়গা পাকা করতে পারেননি। যে কারণে দলটার মধ্যমণি হয়ে উঠতে পারেননি কেউই।
অন্যদিকে, কোচিং ইউনিট থেকেও নেই সুস্পষ্ট পরিকল্পনা। কখনো উইকেটের ধীর গতিকে দোষারোপ, কখনো ফরম্যাট বদল-এসব ব্যাখ্যা শুনে মনে হয় দলের সমস্যাগুলো বোঝার চেষ্টাই করা হচ্ছে না। এক সময় বাংলাদেশের শক্তি ছিল স্পিনাররা, এখন সেই শক্তিকেই ভয় মনে হচ্ছে। রশিদ খান বা মুজিবদের মতো বোলারদের বিপক্ষে মোকাবিলা করার কৌশল কী হবে, তা নিয়েও নেই কোনো পরিকল্পিত প্রস্তুতি। মানসিকভাবে ভেঙে পড়া এই দলের জন্য এখন সবচেয়ে জরুরি বিষয় হলো আত্মবিশ্বাস পুনরুদ্ধার। প্রতিটি পরাজয়ের পর একই বক্তব্য- ‘আমরা শিখব, ফিরে আসব’ এমন প্রতিশ্রুতি এখন আর কাউকে আশ্বস্ত করে না। কারণ কথায় নয়, মাঠে প্রতিফলনই প্রমাণ দেয় পরিবর্তনের। কিন্তু বাংলাদেশ দলে সেই বাস্তব পরিবর্তনের কোনো ইঙ্গিত নেই।
ওয়ানডেতে টিকে থাকতে হলে ব্যাটিং ইউনিটকে নতুনভাবে গঠন করতে হবে। টপ অর্ডারে স্থায়িত্ব, মিডল অর্ডারে দায়িত্ব এবং মানসিক দৃঢ়তা-এই তিন স্তম্ভের ওপর দাঁড়াতে হবে নতুন করে। শুধু প্রতিপক্ষের নাম শুনে মানসিকভাবে হেরে গেলে কোনো ফরম্যাটেই টিকে থাকা সম্ভব নয়। এখন প্রশ্ন একটাই-বাংলাদেশ কি আসলে উন্নতির পথে এগোচ্ছে, নাকি কেবলই ব্যর্থতার কারণ খুঁজে বেড়াচ্ছে? ফরম্যাটের অজুহাত দিয়ে হয়তো সাময়িক স্বস্তি পাওয়া যায়, কিন্তু ক্রিকেটে দীর্ঘ মেয়াদে টিকে থাকতে হলে সেই অজুহাত নয়, প্রয়োজন কঠিন আত্মসমালোচনা। আর সেই আত্মসমালোচনার সাহসটাই যেন হারিয়ে ফেলেছে বাংলাদেশ।
আগামীকাল সিরিজের তৃতীয় ও শেষ ওয়ানডে মাঠে গড়াবে। এই ম্যাচে হারলে হোয়াইটওয়াশের লজ্জা পাবে বাংলাদেশ। গেল তিন বছর ধরে আফগানদের বিপক্ষে ৫০ ওভারের সিরিজ জিততে না পারার বাজে অভ্যাস তৈরি হয়েছে বাংলাদেশের। এবার তার পিঠে দাঁড়িয়ে হোয়াইটওয়াশ এড়ানো সম্ভব হবে কিনা, সেটিই দেখার বিষয়।