
বাংলাদেশ-আফগানিস্তান মুখোমুখি হলেই এখন একটা আলাদা প্রতিদ্বন্দ্বিতার আবহ তৈরি হয়। দুই দলই প্রায় প্রতি বছরই একে অন্যের বিপক্ষে সিরিজ খেলছে, আর প্রতিবারই গল্প তৈরি হচ্ছে নতুনভাবে। এবারও তার ব্যতিক্রম নয়। আবুধাবিতে তিন ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজে প্রথম ম্যাচে ৫ উইকেটের জয়ে আফগানিস্তান এগিয়ে গেছে ১-০ ব্যবধানে। ফলে সিরিজের দ্বিতীয় ম্যাচের আগে তাদের চোখ এখন টানা তৃতীয় ওয়ানডে সিরিজ জয়ের দিকে। আজ বাংলাদেশ-আফগানিস্তানের দ্বিতীয় ওয়ানডে মাঠে গড়াবে সন্ধ্যা ৬টায়।
গত দুই বছরেই বাংলাদেশকে হারিয়ে সিরিজ জিতেছিল আফগানরা-২০২৩ সালে চট্টগ্রামে, ২০২৪ সালে বাংলাদেশের শারজায়। ২০২৫ সালে আবুধাবি সিরিজেও একই পথেই এগোচ্ছে তারা। প্রথম ম্যাচের জয়ের পর আফগানদের আত্মবিশ্বাস চূড়ান্ত পর্যায়ে। এবারের প্রথম ম্যাচেই জয়ের নায়ক ছিলেন দুই জন-আজমতউল্লাহ ওমরজাই আর রশিদ খান।
ওমরজাই ছিলেন আসল অলরাউন্ড পারফরমার, প্রথমে বল হাতে ৩ উইকেট নিয়ে বাংলাদেশের ব্যাটিংয়ের মেরুদণ্ড ভেঙে দেন, পরে ব্যাট হাতে নেমে ৪০ রানের ইনিংসে দলকে জয়ের বন্দরে পৌছে দেন। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় এই তরুণ অলরাউন্ডারের উত্থান আফগান ক্রিকেটের অন্যতম বড় সাফল্যের গল্প। অন্যদিকে রশিদ খান আবার নিজের জায়গায় ছিলেন অনন্য। ৩৮ রানে ৩ উইকেট নিয়ে তিনি শুধু ম্যাচের মোড় ঘুরিয়ে দেননি, একই সঙ্গে ছুঁয়ে ফেলেছেন এক অনন্য মাইলফলক-ওয়ানডেতে ২০০ উইকেট।
আফগানিস্তানের ইতিহাসে এই অর্জন রশিদের জাদুরই এক নতুন অধ্যায়। তবে আফগানিস্তানের জয়ের আসল রহস্য শুধু তারকাদের হাতে সীমাবদ্ধ নয়। বরং তাদের সাফল্যের ভিত গড়ে ওঠে সেইসব তারকাদের হাতে, যাদের নাম হয়তো শিরোনামে আসে না, কিন্তু ম্যাচের নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখেন তারাই। যেমন বাঁহাতি স্পিনার নাঙ্গেয়ালিয়া খারোতে। ১০ ওভারে মাত্র ৩২ রান দিয়ে নিয়েছেন সাইফ হাসানের উইকেট, এমন এক স্পেল যেটি আফগানদের ম্যাচে ছন্দ দিয়েছে।
আর আফগানদের ব্যাট হাতে শান্ত শুরুর পর দলকে সামলে নিয়েছেন রহমত শাহ। ৭৮ রানের তৃতীয় উইকেট জুটিতে রহমানউল্লাহ গুরবাজের সঙ্গে গড়ে তোলেন জয়ের ভিত। রহমতের ইনিংস হয়তো চোখ ধাঁধানো ছিল না, কিন্তু তা ছিল ভিত্তি রচনার মতো অপরিহার্য। তিনি আফগান ব্যাটিংয়ের সেই নীরব চালক, যার পেছনের স্থিরতায় ওমরজাই বা রশিদরা পরের গল্প লিখতে পারেন। গুরবাজও ছিলেন দায়িত্বশীল।
অন্যদিকে বাংলাদেশ যেন বারবার একই গল্পের পুনরাবৃত্তি করছে। টি-টোয়েন্টিতে আফগানদের হোয়াইটওয়াশ করার পরও ওয়ানডে ফরম্যাটে তাদের ছন্দ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না গত ১২ মাসে মাত্র দুইটি ওয়ানডে জয়, যা তাদের নামিয়ে দিয়েছে আইসিসি র্যাংকিংয়ের ১০ নম্বরে। আবুধাবির ধীর পিচে খেলতে নেমে তারা আবারও হারিয়েছে পুরোনো ছন্দ।
প্রথম ম্যাচে ১০১ রানের দারুণ জুটি গড়েছিলেন তাওহীদ হৃদয় ও মেহেদী হাসান মিরাজ। দুই জনই পেয়েছিলেন হাফ-সেঞ্চুরি। হৃদয় ৫৬, মিরাজ ৬০। কিন্তু এই দুই জনের আউটের পর ভেঙে পড়ে পুরে ব্যাটিং লাইনআপ। রশিদের নিখুঁত গুগলিতে একে একে ফেরেন মিরাজ, জাকের আলী অনিক ও নুরুল হাসান সোহান। শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ অলআউট হয় ২২১ রানে, আর আফগানিস্তান জয় তুলে নেয় ১৭ বল হাতে রেখে।
কোচ ফিল সিমন্স নিশ্চয়ই ভাবছেন-এই ব্যাটিংয়ের সমস্যা কোথায়? টপ অর্ডার বারবার ব্যর্থ হচ্ছে, আর যারা সেট হচ্ছে তারা লম্বা ইনিংস খেলতে পারছেন না। আরও বড় সমস্যা ‘ডট বল’ প্রথম ম্যাচে বাংলাদেশ ৫৭ শতাংশ বল খেলেছে রান ছাড়া-১৬৮টি বল! আফগানিস্তান খেলেছে ৫৩ শতাংশ ডট। পার্থক্য এখানেই। তাতে দলের পরিকল্পনাতেও প্রশ্ন উঠেছে। আফগানিস্তান যেখানে চার স্পিনার খেলিয়েছে-রশিদ, খারোতে গজনফর, নবি-বাংলাদেশ সেখানে একাদশে রাখেনি লেগ স্পিনার রিশাদ হোসেনকে। পিচ ধীর হওয়া সত্ত্বেও এই সিদ্ধান্ত এখন অনেকের কাছেই অদ্ভুত মনে হচ্ছে।
আজ দ্বিতীয় ওয়ানডেতে তাই পরিবর্তন আসতে পারে বাংলাদেশ দলে। রিশাদ হোসেনের ফেরার সম্ভাবনা আছে। ওপেনার হিসেবে নাঈম শেখও যোগ দিচ্ছেন দলে। এটি অন্তত দলের জন্য কিছুটা স্বস্তির খবর। আজ আফগানিস্তানের একাদশে পরিবর্তনের সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। গুরবাজ, ইব্রাহিম জাদরান, রহমত শাহ, শাহিদি ওমরজাই-এই ব্যাটিং লাইনটাই তাদের সবচেয়ে বড় ভরসা। সঙ্গে আছেন নবি, রশিদ, গজনফর খারোতে, বশির আহমদ-এক নিখুঁত ভারসাম্যপূর্ণ দল।
আবুধাবির শেখ জায়েদ স্টেডিয়ামের পিচ আবারও ধীরগতিরই থাকবে বলে আশা ব্যাটারদের এখনই নিজেদের মানিয়ে নিতে হবে, নয়তো রানবোর্ডে প্রতিবারই ধুকতে হবে। বাংলাদেশের জন্য এ ম্যাচ তাই অনেক কিছু নির্ধারণ করে দেবে। সিরিজে টিকে থাকার লড়াই আত্মবিশ্বাস ফিরে পাওয়ার চেষ্টা-সব একসঙ্গে আর আফগানিস্তানের জন্য এটি হতে পারে ইতিহাসের আরেকটি অধ্যায়, বাংলাদেশের বিপক্ষে টানা তৃতীয় ওয়ানডে সিরিজ জয়ের। আফগানদের সেই যাত্রা থেকে রক্ষা করতে পারেন বাংলাদেশের ব্যাটাররাই।