
আফগানিস্তানের মাটিতে কোনো “বিদেশি” শক্তির “নিয়ন্ত্রণ” মেনে নেওয়া হবে না। ভারত সফরে এসে এমনটাই জানিয়েছেন সে দেশের তালেবান পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির খান মুত্তাকি। বারগাম বিমান ঘাঁটির আবার মার্কিন নিয়ন্ত্রণে ফিরিয়ে দেওয়ার যে আহ্বান জানিয়েছিলেন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প, সেই প্রসঙ্গে এই মন্তব্য করেছেন আমির খান মুত্তাকি।
ভারত সফরের দ্বিতীয় দিনে দিল্লির আফগান দূতাবাসে আয়োজিত এক সাংবাদিক সম্মেলনে তিনি এই মন্তব্য করেন। তালেবান শাসিত আফগানিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এই প্রথমবার ভারত সফরে এসেছেন। এর জন্য জাতিসংঘের বিশেষ ছাড়ের প্রয়োজন পড়েছে, কারণ “নিষিদ্ধ সন্ত্রাসীদের” তালিকায় রয়েছেন মুত্তাকি।
আফগানিস্তানে তালেবান সরকার ক্ষমতায় ফেরার পর কাবুলের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কের সমীকরণে বদল এসেছিল। তালেবান সরকারের সঙ্গে “সন্তর্পণে দূরত্ব” তৈরি করতে দেখা গিয়েছিল ভারতকে।
সেই দৃশ্যও সম্প্রতি বদলেছে। সম্প্রতি দুই দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মধ্যে একাধিকবার যোগাযোগ হয়েছে। তারপরই মুত্তাকির এই ভারত সফর।
সফরের দ্বিতীয় দিনেই ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এস জয়শঙ্করের সঙ্গে তার বৈঠক হয়েছে। কাবুলে ভারতের টেকনিক্যাল মিশনকে দূতাবাসের মর্যাদায় উন্নীত করার ঘোষণা করেছেন জয়শঙ্কর।
পরে শুক্রবার বিকেলে বাছাই করা সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন আমির খান মুস্তাকি। তবে সেই সাংবাদিক সম্মেলনে শুধু পুরুষ সাংবাদিকদেরই উপস্থিতি ছিল। তা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন অনেকেই।
এদিকে, ভারতের মাটিতে বসে একাধিক দেশের বিষয়ে মন্তব্য করেছেন মুক্তাকি। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ক্ষোভ উগড়ে দিয়েছেন। সতর্ক করার সুরে জানিয়েছেন, আফগানিস্তানে উস্কে দেওয়ার মতো কাজ যেন তারা না করে।
আবার যুক্তরাষ্ট্রকে এই বার্তা দিতেও ছাড়েননি যে বারগাম বিমান ঘাঁটিতে অন্য কারো নিয়ন্ত্রণ চলবে না। পাশাপাশি তার দাবি, তালেবান শাসিত আফগানিস্তানে “শান্তি” রয়েছে এবং নারীদের স্বাধীনতা খর্বের প্রসঙ্গে দাবি করেছেন যে, সেখানে “সকলের অধিকার” সংরক্ষণ করা হয়।
প্রসঙ্গত, তালেবান সরকারকে এখনো আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয়নি ভারত।
কাবুলে ভারতীয় দূতাবাস
ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করের সঙ্গে শুক্রবার বৈঠক করেছেন মুত্তাকি। সেই সময় ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ঘোষণা করেন আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুলে দূতাবাস ফের চালু করার হবে।
তিনি মুত্তাকিকে বলেন, কাবুলে ভারতের টেকনিক্যাল মিশনকে ভারতীয় দূতাবাসের স্তরে উন্নীত করার ঘোষণা করতে পেরে আমি আনন্দিত।
প্রসঙ্গত, ২০২১ সালের অগাস্ট মাসে আফগানিস্তানে তালেবান ক্ষমতায় ফেরার পর ভারত কাবুলে তাদের দূতাবাস বন্ধ করে দেয়। এক বছর পর বাণিজ্য, চিকিৎসা সহায়তা এবং মানবিক সহায়তার মতো বিষয়গুলোকে সহজতর করার জন্য সেখানে ছোট মিশন খোলা হয়।
তবে সেই সম্পর্কে ধীরে ধীরে বদল যে এসেছে তা স্পষ্ট।
আফগানিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে স্বাগত জানিয়ে জয়শঙ্কর বলেন, ভারত ও আফগানিস্তানের সম্পর্কের জন্য আপনার এই সফর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমরা আমাদের দীর্ঘমেয়াদী অংশীদারিত্বের প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
অন্যদিকে, ভারতকে আফগানিস্তানের ঘনিষ্ঠ বন্ধু বলে সম্বোধন করেছেন আফগানিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী।
তিনি বলেছেন, আফগানিস্তানে সাম্প্রতিক ভূমিকম্পের সময় ভারতই প্রথম পাশে দাড়িয়েছিল। আফগানিস্তান ভারতকে ঘনিষ্ঠ বন্ধু হিসেবে দেখে। আমরা পারস্পরিক শ্রদ্ধা, বাণিজ্য এবং মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের উপর ভিত্তি করে সম্পর্ক চাই।
ভারত এবং আফগানিস্তান দুই দেশই “সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে” জানিয়ে তিনি বলেছেন, আফগানিস্তানের ভূখণ্ডকে অন্য “কাউকে ব্যবহার করতে দেওয়া হবে না।” তার ইঙ্গিত পাকিস্তানের দিকে।
দুই দেশের প্রতিনিধিদের বৈঠকে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে মজবুত করার জোর দেওয়া হয়। চলতি বছরের এপ্রিলে আফগানিস্তানের বাসিন্দাদের জন্য নতুন ভিসা ব্যবস্থা চালু করেছে ভারত। এর আওতায় চিকিৎসা, ব্যবসা এবং শিক্ষা ক্ষেত্রে আরও বেশি সংখ্যক ভিসা দেওয়া হচ্ছে।
শুধু তাই নয়, ভারত সে দেশে খাদ্য সহায়তাও দিচ্ছে। সেই ধারা অব্যাহত রাখা হবে বলে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানিয়েছেন।
পাশাপাশি আফগানিস্তানকে ২০টা অ্যাম্বুলেন্স দেবে ভারত যার মধ্যে পাঁচটা শুক্রবারই দেওয়া হয়েছে। আফগান শরণার্থীদের পুনর্বাসনের জন্যও ভারত কাজ করবে জানানো হয়েছে।
দুই দেশের প্রতিনিধিদের মধ্যে উচ্চস্তরের বৈঠকের পর শুক্রবারই দিল্লিতে সাংবাদিক সম্মেলন করেছেন মুত্তাকি। যেখানে বাছাই করা সংবাদিকদের ডাকা হয়েছিল।
সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তর তিনি হিন্দিতেও দিয়েছেন। প্রসঙ্গত, এই সাংবাদিক সম্মেলনে শুধুমাত্র পুরুষ সাংবাদিকদেরই উপস্থিতি চোখে পড়েছে। বিষয়টা নিয়ে অনেকে সরবও হয়েছেন। সেই সাংবাদিক সম্মেলনেই পাকিস্তান, মানবাধিকারসহ বিভিন্ন ইস্যুতে প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন।
সাম্প্রতিক সময়ে তালেবান শাসিত আফগানিস্তানের সঙ্গে দিল্লির আবার সম্পর্ক তৈরির নেপথ্যে পাকিস্তান রয়েছে বলে অনেকই মনে করেন। কারণ আফগানিস্তানের সঙ্গে পাকিস্তানের ইতিমধ্যে সম্পর্কের অবনতি হয়েছে।
বৃহস্পতিবার ভারত ও আফগানিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দু’জনেই পাকিস্তানের বিরুদ্ধে মন্তব্য করেন। পরে সাংবাদিক সম্মেলনের সময় পাকিস্তানের উদ্দেশ্যে ‘সতর্কবার্তা’ দিতে দেখা যায় মুত্তাকিকে।
ভারতের রাজধানী থেকেই পাকিস্তানকে কিছুটা হুঁশিয়ারির সুরেই ‘খেলা বন্ধ’ করার বার্তা দিয়েছেন।
তিনি জানিয়ে দিয়েছেন, আফগানদের “সাহস পরীক্ষা করার কথা” যেন কোনো মতেই না ভাবা হয়। এই প্রসঙ্গে কথা বলতে গিয়ে তিনি যুক্তরাষ্ট্র এবং নেটোর প্রসঙ্গও টেনে এনেছেন।
কাবুলে হামলার প্রসঙ্গ টেনে তিনি পাকিস্তানের উদ্দেশ্যে বলেছেন, সীমান্তের কাছে প্রত্যন্ত অঞ্চলে হামলা হয়েছে। পাকিস্তানের এই কাজকে ভুল বলে আমরা মনে করি। ৪০ বছর পর আফগানিস্তানে শান্তি ও অগ্রগতি হয়েছে। আফগানদের সাহস পরীক্ষা করা উচিত নয়। যদি কেউ তা করতে চায়, তাহলে তাদের উচিৎ সোভিয়েত ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র এবং নেটোকে জিজ্ঞাসা করা, যাতে তারাই ব্যাখ্যা করে দিতে পারে যে আফগানিস্তানের সাথে খেলা করলে ভালো হয় না।