
একবিংশ শতাব্দীর আলোড়ন সৃষ্টিকারী উদ্ভাবনের মাঝে আর্থিক প্রযুক্তি বা হালের ফিনটেক বা ফিন্যান্সিয়াল টেকনোলজি প্রথম সারিতে থাকবে। উন্নয়নশীল অর্থনীতিতে নারীর জীবনকে দ্রুত আর্থিকভাবে সক্ষম করার সম্ভাবনা ফিনটেকের রয়েছে। তবে সেটি শুধুমাত্র তখনই সম্ভবপর হয়, যখন উদ্ভাবনকে অন্তর্ভুক্তির সাথে মেলানোর পথ সুগম হয়। এখনো দেশের অধিকাংশ ব্যক্তির কাছে ফিনটেক ধারণাটি পরিষ্কার নয়। যার কারণে অনেকেই ডিজিটাল অথবা মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসকেই শুধুমাত্র এর আওতাভুক্ত মনে করছেন। বাংলাদেশের ডিজিটাল অর্থনীতি দ্রুত সম্প্রসারিত হলেও নারীদের এখনো ফিনটেক খাতে লিঙ্গ বৈষম্য পরিলক্ষিত হচ্ছে। যেটি টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা এবং সরকার কর্তৃক গৃহীত জাতীয় আর্থিক অন্তর্ভুক্তি কৌশল বাস্তবায়নের পথে অন্তরায়।
বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬ সালে দেশে মাত্র ১ শতাংশ নারী মোবাইল ব্যাংকিং ব্যবহার করতেন। ২০২৫ সালে এই সংখ্যা বাড়লেও, এখন পর্যন্ত ডাবল ডিজিট অতিক্রম করতে পারেনি। মোট মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস অ্যাকাউন্টধারীদের মধ্যে নারীরা বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী ৪৩ শতাংশের কাছাকাছি। সাম্প্রতিক সময়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ব্যাপকভাবে বা নিয়ন্ত্রক প্রযুক্তি ব্যবহারের পাশাপাশি শিক্ষার সকল স্তরেই আর্থিক সাক্ষরতার ক্রমবিকাশ এবং সক্ষমতা বৃদ্ধিকরণে একাগ্রচিত্তে কাজ করে যাচ্ছে।
নারীরা যারা ডিজিটাল আর্থিক ভবিষ্যৎ গঠন করবেন, তাদের ক্ষমতায়নে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অংশ হিসেবে কেবল ব্যবহারকারী হিসেবে নয়, সমান্তরালভাবে উদ্ভাবক, উদ্যোক্তা ও বিনিয়োগকারীর ভূমিকায় সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। নারীদের ফিনটেক খাতে পুরোপুরি অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে আরও কিছু পদক্ষেপ দরকার। প্রথমত, নারীদের জন্য এমন ডিজিটাল সেবা তৈরি করা দরকার যা তাদের জীবনধারার সঙ্গে খাপ খায়। দ্বিতীয়ত, প্রশিক্ষণ ও দক্ষতা বাড়াতে কর্মশালা, অনলাইন কোর্স বা হ্যাকাথনের মতো কার্যক্রম জরুরি। তৃতীয়ত, সামাজিক বাধা দূর করতে সচেতনতা বৃদ্ধি ও নীতি সংস্কারের প্রয়োজন।
আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে ব্যাপক বৈদেশিক বিনিয়োগ থাকা সত্ত্বেও নারী উদ্যোক্তাদের জন্য সীমান্তবর্তী এবং ক্রমবর্ধমান আর্থিক প্রযুক্তির বিস্তার সন্তোষজনক নয়। কুটির, অতিক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো এই পরিষেবা বুনিয়াদি স্তরে পেয়ে থাকলেও সর্বাবস্থায় পরিশীলিত ও সুসংগঠিত উপায়ে পাচ্ছে না। ব্যবহারকারী ইন্টারফেসের জটিলতার জন্য প্রান্তিক নারীরা অনেকেই গুরুত্বপূর্ণ কাজে প্রযুক্তির ওপর নির্ভর করতে পারছেন না, তৃণমূলে ফিনটেকের দ্রুত বিস্তার লাভে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে।
এর বাইরে সার্বক্ষণিক অসাধুচক্রের জালিয়াতি ও প্রতারণার ফলে ফিনটেক সুপার অ্যাপসগুলোর সর্বাঙ্গিক ব্যবহারে অনেকেই আতঙ্ক বোধ করে থাকেন। বর্তমানে নারী উদ্যোক্তাদের ফিনটেক প্রশিক্ষণে আন্তর্জাতিক মানের প্রোগ্রামের অভাব রয়েছে। বেশকিছু বেসরকারি প্রতিষ্ঠান প্রশিক্ষণ দিচ্ছে, কিন্তু সরকারি বা বড় উদ্যোগ এখন পর্যাপ্ত নয়। এর ফলে নারীরা ডিজিটাল অর্থনীতির পুরো সুযোগ গ্রহণ করতে পারছে না। আইপিডিসি ফাইন্যান্স নারী উদ্যোক্তাদের জন্য ‘জয়ী’ নামে একটি বিশেষায়িত কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করেছে।
এর অধীনে নারী উদ্যোক্তাগণ বিশেষ লোন সুবিধা, ব্যবসায়িক মিটিংয়ের জন্য জয়ী ৩৬০ উপশাখা, কর্মশালা ও প্রশিক্ষণ এবং আর্থিক সেবাসংক্রান্ত বিভিন্ন সহায়তা গ্রহণ করতে পারবেন। নারীদের ফিনটেক শিল্প এবং আনুষঙ্গিক খাতে সাফল্য লাভের মাধ্যমে অর্থনীতি ধারাক্রমে শক্তিশালী হয়ে ওঠে। যার ফলস্বরূপ পরিবারগুলো আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হয়ে ওঠার সুযোগ তৈরি হয় এবং আর্থিক অন্তর্ভুক্তি কেবল একটি কর্মপন্থার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না।