
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডেনাল্ড ট্রাম্প প্রস্তাবিত শান্তি পরিকল্পনা অনুযায়ী গাজা যুদ্ধের অবসানে একটি চূড়ান্ত চুক্তিতে পৌঁছাতে মিশরীয় শহর শার্ম আল শেখে পরোক্ষ বা অনানুষ্ঠানিক আলোচনা শুরু হয়েছে।
ফিলিস্তিনি ও মিশরীয় কর্মকর্তারা বিবিসিকে বলেছেন, এই বৈঠকে মূলত সম্ভাব্য বন্দি বিনিময়ের জন্য ‘মাঠ পর্যায়ের পরিবেশ তৈরি’ করা নিয়ে আলোচনা প্রাধান্য পাচ্ছে। যাতে ইসরায়েলি সব জিম্মির মুক্তির বিনিময়ে ফিলিস্তিনি বন্দিরা মুক্তি পেতে পারে।
হামাস জানিয়েছে, তারা এই শান্তি পরিকল্পনার প্রস্তাবে আংশিকভাবে সম্মত হয়েছে। কিন্তু বেশ কিছু মূল বা গুরুত্বপূর্ণ দাবি যেমন নিরস্ত্রীকরণ এবং গাজার ভবিষ্যত সরকারের নিজেদের ভূমিকা নিয়ে তারা সাড়া দেয়নি।
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী শনিবার বলেছেন, ‘সামনের দিনগুলোতে’ জিম্মিদের মুক্তির ঘোষণা দেওয়ার আশা করছেন।
এই আলোচনায় ইসরায়েল এবং হামাস উভয়েরই প্রতিনিধিদের সঙ্গে পৃথকভাবে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে বৈঠক করবেন মিশরীয় ও কাতারীয় কর্মকর্তারা।
এদিকে, সোমবার কর্মকর্তারা যখন বৈঠকে মিলিত হন, তখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প হোয়াইট হাউসে সাংবাদিকদের বলেন, আমাদের কাছে একটি চুক্তি করার সত্যিই ভালো সুযোগ রয়েছে এবং এটি হবে একটি স্থায়ী চুক্তি।
২০২৩ সালের সাতই অক্টোবর দক্ষিণ ইসরায়েলে হামাসের নেতৃত্বাধীন হামলার দ্বিতীয় বার্ষিকীর ঠিক আগে আগে এই আলোচনা অনুষ্ঠিত হচ্ছে।
এই হামলায় প্রায় ১২০০ জন নিহত এবং ২৫১ জনকে জিম্মি করা হয়েছিল। এই হামলার পাল্টা জবাবে গাজায় অভিযান শুরু করে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী।
হামাস পরিচালিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, সে সময় থেকে গাজায় এই সামরিক অভিযানে ৬৭ হাজার ১৬০ জন নিহত হয়েছে, হামাস-পরিচালিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী যাদের মধ্যে ১৮ হাজার শিশুও রয়েছে।
ইসরায়েলে হামলার বার্ষিকী উপলক্ষে এক বিবৃতিতে জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেন, ট্রাম্পের পরিকল্পনা “এই মর্মান্তিক সংঘাতের অবসান ঘটানোর জন্য একটি সুযোগ এনে দিয়েছে যা কাজে লাগাতে হবে”।
যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী স্যার কিয়ের স্টারমার বার্ষিকী উপলক্ষে তার বিবৃতিতে এই পরিকল্পনার প্রতি তার সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করে বলেছেন, “আমরা মধ্যপ্রাচ্যে শান্তির জন্য মার্কিন উদ্যোগকে স্বাগত জানাই এবং এই সরকার এমন একটি দিন আনার জন্য আমাদের ক্ষমতার মধ্যে সবকিছু করবে যেখানে ইসরায়েলের প্রতিটি শিশু তাদের ফিলিস্তিনি প্রতিবেশীদের সাথে, নিরাপদে ও নিরাপত্তার সাথে শান্তিতে বসবাস করতে পারবে।”
ইসরায়েলি নিরাপত্তা বাহিনীর একটি সূত্র জানিয়েছেন, আলোচনা প্রাথমিকভাবে কেবল জিম্মিদের মুক্তির ওপর আলোকপাত করবে এবং হামাসকে সেই পর্যায়টি সম্পন্ন করার জন্য কয়েক দিন সময় দেওয়া হবে।
মিশরে আলোচনায় যারা উপস্থিত ছিলেন তাদের মধ্যে রয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফ, ট্রাম্পের জামাতা জ্যারেড কুশনার এবং কাতারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শেখ মোহাম্মদ বিন আব্দুল রহমান আল থানি।
গাজা যুদ্ধের অবসানের প্রচেষ্টায় জড়িত সকলকে ‘দ্রুত এগিয়ে যাওয়ার’ আহ্বান জানিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লিখেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প।
তিনি বলেছেন, তাকে বলা হয়েছে, শান্তি পরিকল্পনার প্রথম ধাপের মধ্যে জিম্মি মুক্তি অন্তর্ভুক্ত।
ট্রাম্প লিখেছেন, জিম্মি মুক্তি এই সপ্তাহে শেষ হওয়া উচিত। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ২০ দফা পরিকল্পনায় একমত হয়েছেন।
এর মধ্যে রয়েছে অবিলম্বে যুদ্ধ বন্ধ এবং আটক শত শত গাজার নাগরিকের বিনিময়ে ৪৮ জন জিম্মিকে মুক্তি দেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। যাদের মধ্যে মাত্র ২০ জন জীবিত বলে মনে করা হচ্ছে।
এই পরিকল্পনায় শর্ত দেওয়া হয়েছে, যদি একবার উভয় পক্ষ এই পরিকল্পনায় রাজি হয় তাহলে “গাজা উপত্যকায় অবিলম্বে পূর্ণাঙ্গ সহায়তা পাঠানো হবে।”
এতে আরও বলা হয়েছে, গাজা শাসনে হামাসের কোনো ভূমিকা থাকবে না এবং চূড়ান্তভাবে একটি ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের জন্য দরজা উন্মুখ রাখা হয়েছে।
কিন্তু এক সপ্তাহ আগে প্রকাশ্যে এই পরিকল্পনা ঘোষণার পর নেতানিয়াহু একটি ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের প্রতি তার দীর্ঘদিনের বিরোধিতা পুনর্ব্যক্ত করেন।
এক ভিডিও বিবৃতিতে তিনি বলেন, “এটা চুক্তিতে লেখা নাই। আমরা বলেছিলাম একটি ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের প্রতি আমরা জোরালোভাবে বিরোধিতা করবো।”
শুক্রবার, হামাস এক বিবৃতিতে এই প্রস্তাবের প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে।
যেখানে এই গ্রুপটি “প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের প্রস্তাবে থাকা বিনিময়ের শর্ত অনুযায়ী জীবিত এবং মৃত সকল ইসরায়েলি বন্দিকে মুক্তি দিতে” রাজি হয়েছে, যদি বিনিময়ের জন্য যথাযথভাবে শর্ত পূরণ করা হয়।
এতে ট্রাম্পের ২০ দফা পরিকল্পনার কথা সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ বা গ্রহণ করা হয়নি।
কিন্তু এতে বলা হয়েছে, এটি “ফিলিস্তিনি জাতীয় ঐকমত্য এবং আরব ও ইসলামী সমর্থনের ভিত্তিতে গাজা উপত্যকার প্রশাসন একটি স্বাধীন ফিলিস্তিনি সংস্থা বা টেকনোক্রেটের কাছে হস্তান্তরের চুক্তি নবায়ন করছে।”
হামাসের এই বিবৃতিতে পরিকল্পনার একটি প্রধান দাবির কথা উল্লেখ করা হয়নি।
যেটি হলো হামাসকে নিরস্ত্রীকরণে রাজি হতে হবে এবং গাজার শাসন ব্যবস্থায় আর কোনো ভূমিকা রাখতে পারবে না।
এতে আরও বলা হয়েছে, গাজার ভবিষ্যৎ এবং ফিলিস্তিনি জনগণের অধিকার সম্পর্কিত প্রস্তাবগুলোর অংশটি এখনো “একটি জাতীয় কাঠামোর মধ্যে” আলোচনা করা হচ্ছে।
এর মধ্যে হামাসও একটি অংশ হিসেবে থাকবে বলে তারা এতে জানিয়েছে। অনেক ফিলিস্তিনি শান্তি পরিকল্পনায় হামাসের এই প্রতিক্রিয়াকে অপ্রত্যাশিত বলে উল্লেখ করছেন।
কারণ কয়েকদিন ধরেই এমন ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছিল যে, হামাস ট্রাম্পের এই শান্তি পরিকল্পনার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান বা অন্তত কঠোর শর্তসাপেক্ষে গ্রহণের প্রস্তুতি নিচ্ছে।
পরিবর্তে, হামাস তাদের অফিসিয়াল এই বিবৃতিতে তাদের ঐতিহ্যবাহী ‘লাল রেখা’ অন্তর্ভুক্ত করা থেকে বিরত থাকে। যেটিকে অনেকেই বহিরাগত চাপের লক্ষণ বলে ব্যাখ্যা করছেন।
ইউরোপীয়ান এবং মধ্যপ্রাচ্যের নেতারা এই প্রস্তাবকে স্বাগত জানিয়েছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের এই প্রচেষ্টাকে ‘আন্তরিক এবং বলিষ্ঠ’ বলে অভিহিত করেছে ইসরায়েলি অধিকৃত পশ্চিম তীরের কিছু অংশ নিয়ন্ত্রণকারী ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ (পিএ)।
বহু বছর ধরে হামাসের অন্যতম পৃষ্ঠপোষক ইরানও এখন ট্রাম্পের এই গাজা শান্তি পরিকল্পনার প্রতি সমর্থনের ইঙ্গিত দিয়েছে।
সোমবার আলোচনা শুরুর আগেও গাজা উপত্যকার বেশ কয়েকটি অংশে ইসরায়েলি বোমাবর্ষণ অব্যাহত ছিল।
বাকি জিম্মিদের মুক্তি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে একটি শহরে ইসরায়েল হামলা চালাচ্ছে বলে দাবি করেছে।
হামাস পরিচালিত গাজার বেসামরিক প্রতিরক্ষা বিভাগের মুখপাত্র মাহমুদ বাসাল বিবিসিকে বলেছেন, “চার সপ্তাহ আগে হামলা শুরু হওয়ার পর থেকে গাজায় কোনো ত্রাণের ট্রাক ঢোকার অনুমতি দেওয়া হয়নি।”
তিনি বলেন, “ইসরায়েলি নিয়ন্ত্রণে থাকা এলাকায় এখনো এমন কিছু মরদেহ রয়েছে যা আমাদের উদ্ধার করা সম্ভব নয়।”
ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর নির্ধারণ করা দক্ষিণে একটি ‘মানবিক এলাকায়’ স্থানান্তরের নির্দেশ দেওয়ার পর থেকে গাজা শহরের লাখ লাখ অধিবাসী পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছে। তবে ধারণা করা হচ্ছে, আরও লাখ লাখ অধিবাসী এখনো রয়ে গেছেন সেখানে।
ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী সতর্ক করে বলেছেন, হামলার সময় যারা থাকবে তারা ‘সন্ত্রাসী এবং সন্ত্রাসের সমর্থক’ হিসেবে বিবেচিত হবে।
হামাস পরিচালিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় তাদের সর্বশেষ এক আপডেটে জানিয়েছে, গত ২৪ ঘণ্টায় গাজায় ২১ জন ফিলিস্তিনি নিহত এবং আরও ৯৬ জন আহত হয়েছেন।
যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে ইসরায়েল আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের সাংবাদিকদের স্বাধীনভাবে গাজা উপত্যকায় প্রবেশ নিষিদ্ধ করেছে। এর ফলে উভয় পক্ষের দাবিগুলো যাচাই করা কঠিন হয়ে পড়েছে।