
বায়ুদূষণ বাড়াচ্ছে হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি। দিন দিন এই ঝুঁকি বেড়েই চলেছে। বিশ্বের দূষিত শহরগুলোর মধ্যে ঢাকা একটি, ফলে ঢাকা শহরে বায়ুদূষণের মাত্রা প্রায় সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছে যায়। গত বছর ডিসেম্বর মাসে এক দিনও নির্মল বায়ু পায়নি রাজধানীবাসী। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বায়ুদূষণের ফলে মানুষ নানাবিধ স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়ছে, যার মধ্যে অন্যতম হার্ট অ্যাটাক। বায়ুদূষণের ফলে উচ্চরক্তচাপ, রক্তনালির ক্ষতি, হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক, অনিয়মিত হার্টের ছন্দ এবং ধমনি শক্ত হয়ে যাওয়ার মতো অসুস্থতার ঝুঁকি বেড়ে যায়।
বিশেষ করে বাতাসে পিএম ২.৫ কণাগুলোর উচ্চমাত্রা উপস্থিতি হৃদরোগের জন্য ক্ষতিকর। বায়ুতে অক্সিজেন যে পরিমাণ থাকার কথা, সেটা থাকে না। দূষিত বায়ুতে মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর নানাবিধ উপাদান থাকে। যে কারণে দূষিত বাতাসের বিভিন্ন ক্ষতিকর উপাদান রক্তনালির লেয়ারকে ক্ষতিগ্রস্ত করে এবং বায়ু দূষিত থাকলে হৃদরোগের ঝুঁকিও বেড়ে যায়। ঢাকার বাতাসে পিএমের উপস্থিতি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) মানমাত্রার চেয়ে ৩৫ গুণ বেশি। পাশাপাশি বাতাসে ধুলাবালি এবং বিষাক্ত উপাদান থাকার ফলে ব্রঙ্কাইটিস, অ্যাজমা এ জাতীয় সমস্যা তৈরি হওয়ার ফলে অক্সিজেনেশন ঠিক মতো হয় না। স্বাভাবিক নির্মল বায়ু থেকে হৃদপিণ্ড যে পরিমাণ অক্সিজেন পাওয়ার কথা, দূষিত বায়ুতে সেই পরিমাণ অক্সিজেন পায় না। ফলে হৃদপিণ্ডের স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত হয়ে ঝুঁকি বাড়ায়।
বায়ুদূষণের পরিস্থিতি নিয়মিত তুলে ধরে সুইজারল্যান্ডভিত্তিক প্রতিষ্ঠান আইকিউ এয়ার। একিউআইয়ের তথ্য বলছে, স্কোরে শূন্য থেকে ৫০ পর্যন্ত ‘ভালো বায়ু’ হিসেবে বিবেচিত হয়। ৫১ থেকে ১০০ পর্যন্ত স্কোর ‘মাঝারি’, যা সংবেদনশীল গোষ্ঠীর জন্য ‘অস্বাস্থ্যকর বিবেচিত হয়’। আর ১০১ থেকে ১৫০ স্কোর। স্কোর ১৫১ থেকে ২০০ হলে ‘অস্বাস্থ্যকর’ এবং ২০১ থেকে ৩০০ স্কোরকে ‘খুবই অস্বাস্থ্যকর’ বলা হয়। এ স্কোর ৩০০-এর ওপরে থাকা ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ বলে বিবেচিত হয়।
বায়ুদূষণ নিয়ে কাজ করা গবেষণাপ্রতিষ্ঠান ক্যাপসের জরিপ বলছে, গত বছর ডিসেম্বর বায়ুদূষণ যতটা ছিল, তা গত ৯ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। ক্যাপসের গবেষণায় আরও বলা হয়েছে যে, গত বছরের ডিসেম্বর বায়ুর গড় মান ছিল ২৮৮। ২০১৬ সালের পর থেকে বায়ুর মান এত খারাপ কখনোই হয়নি। ২০২৩ সালের ডিসেম্বর বায়ুর মান ছিল ১৯৫। গত ৯ বছরে ডিসেম্বর ঢাকার বায়ুর মান ছিল ২১৯ দশমিক ৫৪। ২০২৪ সালের ডিসেম্বর এ মান ৩১ শতাংশের বেশি বেড়ে যায়। আর ২০২৩ সালের তুলনায় বেড়েছে ২৬ শতাংশেরও বেশি। বিশ্বের ১২৪ নগরীর মধ্যে ১৩ জানুয়ারি সকালে ঢাকা বায়ুদূষণে দ্বিতীয় স্থানে ছিল। এদিন সকাল সাড়ে ৮টার দিকে আইকিউ এয়ারের মান সূচকে ঢাকার বায়ুর মান ছিল ২৫২। বায়ুর এ মানকে ‘খুব অস্বাস্থ্যকর’ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাজধানীতে অনবরত ভারী যানবাহন চলাচল, বিভিন্ন কনস্ট্রাকশনের কাজ, গাড়ির উচ্চ শব্দ বা হর্ন, এসবের ফলে মানুষের ওপর সাইকোলজিক্যাল প্রেসার পড়ছে, মানসিক অশান্তি এবং অস্থিরতা বাড়ছে। ফলে মানুষ ঠিকমতো ঘুমাতে পারছে না। এসবের প্রভাব পড়ছে হৃদপিণ্ডে। ফলে বায়ুদূষণের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ দুটি কারণেই হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়াচ্ছে বায়ুদূষণ। তারা বলছেন, বায়ুদূষণের ফলে মানুষ বহুবিধ স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়ে। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে হার্ট অ্যাটাক। বায়ুদূষণের ফলে উচ্চ রক্তচাপ, রক্তনালীর ক্ষতি, হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক, অনিয়মিত হার্টের ছন্দ এবং ধমনি শক্ত হয়ে যাওয়ার মতো অসুস্থতার ঝুঁকি বেড়ে যায়।
ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হসপিটাল অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউটের ইপিডেমিওলজি অ্যান্ড রিসার্চ বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. সোহেল রেজা চৌধুরী বলেন, ‘ইদানীং আমরা দেখতে পাচ্ছি বায়ুদূষণের মাত্রা বেড়ে গেলে হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি বেড়ে যায়। বায়ুদূষণে যেসব উপাদান আছে, বিশেষ করে পিএম ২.৫ কণা ফুসফুসের ভেতরে প্রবেশ করে প্রদাহ সৃষ্টি করে। ফলে অক্সিজেনেশন কমে যায়, ধমনির গায়ে চর্বির পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়। সেই কারণেই বায়ুদূষণের মাত্রা বেশি থাকলে ধমনি সরু হয়ে হার্ট অ্যাটাক হয়।’
এই বিশেষজ্ঞ জানান, ‘বাংলাদেশে ব্যাপকসংখ্যক মানুষ এখন হৃদরোগে আক্রান্ত হচ্ছে। পাশাপাশি শীতকালে যখন বায়ুদূষণের মাত্রা বাড়ে, তখন আমাদের হাসপাতালগুলোতে হার্ট অ্যাটাকের রোগীও অনেক বেড়ে যায় এবং মৃত্যুও বাড়ে। সুতরাং বায়ুদূষণ যেভাবে বেড়েছে, সেটা আমাদের জন্য যথেষ্ট উদ্বেগজনক।’
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছে, বিশ্বে যত হার্ট অ্যাটাক হয়, তার ২৫ শতাংশ বায়ুদূষণজনিত কারণে হয়। একজন মানুষের শরীরে যত ধরনের রোগ হয়, তার সবকিছুর সঙ্গেই বায়ুদূষণের যোগ রয়েছে। এই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক বলেন, দূষণটাকে নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। তার জন্য একটি সমন্বিত কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে এবং সেটি গ্রহণ না করে, বায়ুদূষণের হাত থেকে পুরোপুরি রক্ষা করা একেবারেই অসম্ভব। হয়তো কিছুটা সময় সাবধানে ঘরের ভেতরে থাকতে পারে. যেখানে দূষণ কিছুটা কম হয়, কিন্তু পুরোপুরি দূষণমুক্ত রাখতে গেলে, বায়ুদূষণকে কমাতেই হবে এবং সেটাকে নিয়ন্ত্রণে আনতেই হবে।