
স্ট্রেচারে আধখোলা চোখে শোয়া রোগী শামসুল আলম। ৭০ বছর বয়সী শামসুল আলম এসেছেন জামালপুর থেকে। তার ছেলে শহিদুল আলম জানান, জমিতে কাজ করতে গিয়ে পড়ে গিয়েছিলেন। কাঁধে ব্যথা পেয়েছেন, এরপর থেকে তিনি উঠে বসতেও পারছেন না। শুরুতে অল্প কিছু খায়, ঠিকমতো কথাও বলতে পারেন না। ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজে নিয়ে গেলে, চিকিৎসক জানিয়েছেন, ‘বাবা স্ট্রোক করেছেন’। আজ এখনে নিয়ে এসেছি, সিটিস্ক্যান করিয়েছিল, কাল আবার আসতে হবে।
গতকাল মঙ্গলবার রাজধানীর আগারগাঁও ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস অ্যান্ড হাসপাতালের নিচতলায় কথা হয় শহিদুল আলমের সঙ্গে। শুধু শামসুল আলমই নন, আরও আছে সারা দেশ থেকে আসা অসংখ্য রোগী। তাদের অধিকাংশই স্ট্রোকের লক্ষণগুলো ঠিকমতো না জানার কারণে সময়ক্ষেপণ করেই আসছেন হাসপাতালে।
এমন পরিস্থিতিতে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো আজ ২৯ অক্টোবর পালিত হচ্ছে বিশ্ব স্ট্রোক দিবস-২০২৫। প্রতি বছর সাধারণ মানুষকে সচেতন করতে বিশ্ব স্ট্রোক দিবস পালিত হয়। এ বছর দিবসের প্রতিপাদ্য ‘এভরি মিনিট কাউন্ট’। এর বাংলা করা হয়েছে ‘প্রতিটি মিনিট গুরুত্বপূর্ণ’।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন, স্ট্রোকের রোগীর জন্য প্রথম চার ঘণ্টা গোল্ডেন আওয়ার, ঐ সময়ের মধ্যে চিকিৎসা নিশ্চিত করতে পারলে ৮০ ভাগ রোগী সুস্থ হয়ে ওঠে। আমাদের দেশের প্রতি ছয় জনে এক জন স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়। আর দেশে স্ট্রোকে আক্রান্তের সংখ্যা ১৮ লাখ। বিপুল সংখ্যক এই রোগীর চিকিৎসায় প্রয়োজন ১ হাজার ৬০০ জন নিউরোসার্জন, দেশে আছেন মাত্র ২১২ জন নিউরোসার্জন।
স্ট্রোক মৃত্যুর প্রধান একটি কারণ হলেও দেশে স্ট্রোক রোগীদের চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা অপ্রতুল। ঢাকাকেন্দ্রিক এই চিকিত্সাব্যবস্থা। রাজধানীর ঢামেক হাসপাতাল, বিএমইউ ও নিউরোসায়েন্সেস হাসপাতাল এবং পাঁচটি বেসরকারি হাসপাতালে স্ট্রোক ব্যবস্থাপনার সুবিধা রয়েছে। এ ছাড়া আট বিভাগে আটটি স্ট্রোক সেন্টার চালুর কথা থাকলেও এখনো তা কার্যকর হয়নি। দেশে স্ট্রোকের চিকিৎসা অপ্রতুল হওয়ায় মৃত্যু ও পঙ্গুত্বের ঝুঁকি বাড়ছে।
ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস হাসপাতালে (নিনস) সহযোগী অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ সেলিম শাহী ইত্তেফাককে বলেন, ‘যদিও পঞ্চাশোর্ধ্ব মানুষের মধ্যে স্ট্রোকের হার বেশি। তবে ইদানীং তরুণদের মধ্যেও স্ট্রোকের প্রবণতা বাড়ছে। বিশ্বব্যাপী বাড়ছে ‘ইয়াং স্ট্রোক’। ৫০ বছর বয়সের নিচে স্ট্রোক হলে তাকে ‘ইয়াং স্ট্রোক’ বলা হয়। অনেকে অল্প বয়সে উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হচ্ছেন অতিরিক্ত ওজনের কারণে, কায়িক পরিশ্রম না করা, ইয়াংদের মধ্যে জাংক ফুড গ্রহণের প্রবণতা বেশি, এছাড়া কিছু ক্ষেত্রে তরুণরা মাদকাসক্ত হচ্ছে। এসব কারণে অতীতের তুলনায় ইদানীং তরুণদের মধ্যে স্ট্রোকের রোগী বেশি পাওয়া যাচ্ছে।’
ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস হাসপাতালের (নিনস) স্ট্রোক ও ইন্টারভেনশনাল নিউরোলজি বিশেষজ্ঞ সহকারী অধ্যাপক ডা. হুমায়ুন কবীর হিমু জানান, স্ট্রোকের আধুনিক চিকিৎসার অন্যতম প্রধান পদ্ধতি হলো আইভি থ্রোম্বোলাইসিস। এটাকে খুব সহজভাবে ব্যাখ্যা করলে বলা যায়, মস্তিষ্কের রক্তনালিতে রক্তপিণ্ড তৈরি হলে রক্ত চলাচল বাধাগ্রস্ত করলে মস্তিষ্কের অংশবিশেষ নষ্ট হয়ে যায়। ফলে মস্তিষ্কের ঐ অংশ কার্যক্ষমতা হারায়। এটাই ইস্কেমিক স্ট্রোক। মস্তিষ্কের রক্তনালিতে জমাট বাঁধা রক্তপিণ্ডক ওষুধের মাধ্যমে গলিয়ে দেয়া যায়। এতে করে বন্ধ রক্তনালি আবার চালু হয়। ফলে মস্তিষ্কের মৃতপ্রায় কোষগুলো রক্ষা পায়। সাধারণত স্ট্রোকে আক্রান্তের সাড়ে চার ঘণ্টার মধ্যে হাসপাতালে এলে এ চিকিৎসা পাওয়া সম্ভব। তবে দেশের সব হাসপাতালে এ চিকিৎসা পাওয়া যায় না। তাহলে কি স্ট্রোকের চিকিৎসা নাই? অবশ্যই চিকিৎসা আছে। তাকে মেকানিক্যাল থ্রোম্বেক্টমির চিকিৎসা দেওয়া যায়। এটি স্ট্রোকের একেবারে আধুনিক চিকিৎসা। এটা ছোটখাটো একটা অপারেশন। ক্যাথল্যাবে করা হয়। হার্ট অ্যাটাক হলে রোগীকে যেমন ক্যাথল্যাবে নিয়ে গিয়ে বন্ধ রক্তনালিতে স্ট্যান্ট বসিয়ে রক্ত চলাচল স্বাভাবিক করা হয়, তেমনিভাবে মেকানিক্যাল থ্রোম্বেক্টমি করা হয়। মেশিনের সাহায্যে রক্তপিণ্ড টেনে বের করা হয়। এতে সফল না হলে একধরনের স্ট্যান্ট সূক্ষ্ম ক্যাথেটারের মধ্যে দিয়ে স্ট্যান্ট নিয়ে গিয়ে রক্তপিণ্ডের মধ্যে বসানো হয়। তিন-পাঁচ মিনিট পর স্ট্যান্ট বের করে আনা হয়। স্ট্যান্টের ফাঁকা জায়গায় রক্তপিণ্ড আটকে যায়। ফলে বন্ধ হওয়া রক্তনালি খুলে যায়। রক্ত চলাচল আবার স্বাভাবিক হয়।
এই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক বলছেন, দেশেই হচ্ছে আধুনিক এই চিকিৎসা। একমাত্র ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস হাসপাতালে (নিনস) মেকানিক্যাল থ্রোম্বেক্টমি প্রতিনিয়ত হচ্ছে। বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতাল ও ইবনে সিনা মেডিক্যাল কলেজ, কল্যাণপুরে এ চিকিৎসা অল্পবিস্তর হচ্ছে।
স্ট্রোক কী এবং ঝুঁকিতে কারা :বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্ট্রোক হচ্ছে মস্তিষ্কের রক্তনালির রোগ। হঠাত্ করে মস্তিষ্কের রক্তসঞ্চালন বন্ধ হয়ে বা রক্তনালি ছিঁড়ে গিয়ে সাধারণত স্ট্রোক হয়ে থাকে। অনেকের ধারণা স্ট্রোক’ হার্টের রোগ। তারা ভুল করে রোগীকে হার্টের চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যান। সাধারণত ৫০ ঊর্ধ্ব মানুষের মধ্যে স্ট্রোক হয় বেশি। এর বাইরেও উচ্চরক্তচাপ, ডায়াবেটিস, রক্তে কোলেস্টরলের অধিক্য কিংবা যারা ধূমপান করেন, অ্যালকোহল পান করেন এবং অন্যান্য মাদকদ্রব্য সেবন করেন, অতিরিক্ত শারীরিক ও মানসিক চাপ, অতিরিক্ত ওজন—এসব কারণের জন্য স্ট্রোক হতে পারে।