
জাপানিরা এমনিতে বিনা কারণে কারো সঙ্গে খুব একটা কথা বলেন না। কিন্তু ওয়ার্ল্ড অ্যাথলেটিকসের উদ্বোধনী দিন মনে হলো জাপানি নাগরিকরা একজন আরেক জনের কাছের মানুষ হয়ে গেলেন। একজন আরেক জনের সঙ্গে কথা বলছেন। ওয়ার্ল্ড অ্যাথলেটিকসের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের জন্য জাপান ন্যাশনাল স্টেডিয়াম খোলার আগেই গেটে গেটে ভিড়। দর্শকের লাইন পড়ে গেল। ওয়ার্ল্ড অ্যাথলেটিকস ঘিরে তাদের আগ্রহের যেন কমতি নেই।
টোকিও অলিম্পিক গেমস সামনে রেখে পুরোনো স্টেডিয়াম ভেঙে ২০১৯ সালে জাপান ন্যাশনাল স্টেডিয়াম নির্মাণ করা হয়। কিন্তু কোভিড বা করোনার কারণে টোকিও অলিম্পিক গেমস এক বছর পিছিয়ে গেলেও সেদিন জাপানি দর্শক মাঠে আসতে পারেননি। টোকিও অলিম্পিক গেমস হয়েছিল ফাঁকা গ্যালারিতে। প্রায় পাঁচ বছর পর আবার সেই স্টেডিয়ামে একসঙ্গে বসতে পারার কারণে জাপানি দর্শকদের মনে উৎফুল্লতা।
মধ্যবয়সী জাপানি নারী কোনিকো ইউসহিওকা বললেন, ‘ওয়াতাসি তাচি ওয়া জিউই দেসু’। তর্জমা করলে যা হয়-আমরা এখন মুক্ত’। মুক্ত বলতে তিনি বোঝাতে চাইছেন করোনা থেকে মুক্ত। কিন্তু করোনা থেকে অনেক আগে মুক্ত হলেও স্টেডিয়ামে একটি বিশ্ব আসরে সাক্ষী হতে পেরে সেই জাপানি নারী দর্শক বলতে চাইছেন করোনার কারণে আটকে গিয়েছিল জীবন। টোকিও অলিম্পিক গেমস দেখার জন্য অনেকেই চার বছর আগে টিকিট কিনে রেখেছিলেন। কিন্তু গ্যালারিতে দর্শক নিষিদ্ধ করায় তারা টিভির পর্দায় খেলা দেখতে বাধ্য হয়েছেন।
গতকাল স্থানীয় সময় বিকালে ২০তম ওয়ার্ল্ড অ্যাথলেটিকসের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার আগে গ্যালারি যখন ফাঁকা, তখন স্টেডিয়ামের বাইরে দর্শক গিজ গিজ করছে। শুধু টোকিওর দর্শক নয়, উদ্বোধনী অনুষ্ঠান দেখতে টোকিওর বাইরে থেকেও দর্শক হাজির হয়েছিল। চিবা শহর থেকে এসেছিলেন হেজিমি হোন্ডা। এই দর্শক তার স্ত্রী এবং ছেলেসহ এসেছেন। তাদের কাছে জীবনটা অন্যরকম লাগছে। বললেন, ‘ওয়াতাশি তাচি ওয়া করোনা নি মাদুরি তাকু নাই।’ পাশে অন্য এক জাপানি ইংরেজিতে বোঝালেন, ‘উই ডোন্ট লাইক টু ব্যাক করোনা।’ আমরা আর করোনার জীবনে ফিরে যেতে চাই না। তরুণ রেনতারো শিবুইয়া বললেন, ‘জিনসেই ওয়া কানতান ইয়োসিওকা’। একজন বাংলাদেশি, অনেক দিন জাপানে থাকেন। তিনি বললেন, ‘ঐ জাপানি বলেছে জীবনটা অনেক কঠিন।’
শিবুইয়া, হেজিমি কিংবা কোনিকোর মুখে উচ্চারিত এমন কষ্টের কথাগুলো যেন পুরো জাপানিদের মনের প্রতিচ্ছবি। জাপানিরা হারিয়ে যাওয়া সময়গুলো ফিরে পেতে উদগ্রীব। পরিশ্রমী জাতি হিসেবে পুরো পৃথিবীতে তাদের মূল্যায়ন হয়। এক সময় জাপানের শত্রুরা বলতেন জাপান নাকি বর্বর জাতি। সে জাতি এখন মানুষের পাশে দাঁড়ায়, বলা হয় উন্নয়নের প্রতীক, লাইনে দাঁড়িয়ে থাকার সীমাহীন ধৈর্য, সবচেয়ে বেশি ভদ্র-নম্র, শৃঙ্খল এবং ক্রীড়াপ্রেমী। ক্রীড়া পাগল ৭০ হাজার মানুষের উপস্থিতিতে জাপান ন্যাশনাল স্টেডিয়ামে ফাঁকা পড়ে থাকা চেয়ারগুলো যেন প্রাণ ফিরে পেয়েছে। প্রায় পাঁচ বছর পর গগনবিদারী চিৎকার শুনল জাপান ন্যাশনাল স্টেডিয়াম। বাবা-মায়ের হাত ধরে আসা শিশু থেকে শুরু করে তরুণ-তরুণীদের উপস্থিতিও বলে দেয় তারা খেলার পথে হাঁটতে চায়।
জাপানের সিংহাসনের উত্তরাধিকারী বর্তমান সম্রাটের ছোট ভাই আকিশিনো মিহা ওয়ার্ল্ড অ্যাথলেটিকসের উদ্বোধন করলেন। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তিনি জানিয়ে গেলেন আগামী প্রজন্মকে ওয়ার্ল্ড অ্যাথলেটিকসের এই সময়টা দারুণভাবে প্রভাবিত করবে।’ ওয়ার্ল্ড অ্যাথলেটিকসের ৪৯ ইভেন্টে লড়াই করতে ২০০ দেশের দুই হাজার অ্যাথলেট এসেছেন জাপানে। আগামী ২১ সেপ্টম্বর পর্যন্ত ভাঙা-গড়ার রেকর্ডই গড়বে না, অ্যাথলেটদের কাছে জাপানের সংস্কৃতি আলাদা করে জায়গা পাবে।’
ওয়ার্ল্ড অ্যাথলেটিকসের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানটি অন্যান্য বিশ্বকাপ ক্রীড়ার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের মতো ছিল না। যারা বর্ণিল উদ্বোধন দেখতে পছন্দ করেন, তাদের কাছে এটি সাদামাটা উদ্বোধন। জাতীয় সংগীত ছিল মূল। আর ছিল জাপানের ঐতিহ্যবাহী ড্রামের সুর।
গতকাল সকালেই শুরু হয়েছিল ইভেন্ট, ৩৫ কিলোমিটার হাঁটা প্রতিযোগিতায় পুরুষ স্বর্ণ জয় করেছেন কানাডার ইভান ডানফি এবং নারী লড়াইয়ে স্পেনের মারিয়া পেরেজ। সন্ধ্যায় জাপান ন্যাশনাল স্টেডিয়ামে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের পর শুরু হয় বিভিন্ন ইভেন্টের লড়াই ১০০ ও ২০০ মিটার নারী ও পুরুষ হিটের লড়াই। হাই জাম্প, লংজাম্প, জ্যাভলিন থ্রো, পোল ভোল্টসহ নানা আয়োজনে মুগ্ধকর ছিল গ্যালারি দর্শকদেরকে। রাতে মুগ্ধতা নিয়ে জাপানিরা ফিরছিলেন। আর পেছনে জাপান ন্যাশনাল স্টেডিয়ামের ভেতরে জায়ান্ট স্ক্রিনে ভাসছিল ‘টোকিও ই ইয়োকোসো (ওয়েলকাম ইন টোকিও), সেকাই রিকুজুও এ ইয়োকোসো (ওয়েলকাম টু ওয়ার্ল্ড অ্যাথলেটিকস)।