
সুদানের একজন বিশ্লেষক বলেছেন, সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং ইসরায়েল সুদানের সংঘাতে গভীরভাবে জড়িত। তার মতে, দেশটিতে বিদেশি হস্তক্ষেপের মূল উদ্দেশ্য হলো, সোনার খনির ওপর নিয়ন্ত্রণ এবং ‘আরবীকরণ’ এজেন্ডা।
আফ্রিকার হর্নে অবস্থিত সমৃদ্ধ ইতিহাস এবং বৈচিত্র্যময় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের দেশটি ২০১৯ সালে প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ওমর আল-বশিরের পতনের পর থেকে সংঘাত এবং বিদেশি হস্তক্ষেপের চক্রে আটকা পড়েছে।
বছরের পর বছর ধরে চলা জনসাধারণের অস্থিরতা এবং অভ্যন্তরীণ চাপের পর ওমর আল-বশিরকে ক্ষমতাচ্যুত করা হলে অস্থিরতার এক নতুন যুগের সূচনা হয়। সুদানি সশস্ত্র বাহিনী এবং র্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেস (আরএসএফ) এক সময় আল-বশিরের শাসনব্যবস্থার পতনে মিত্র হিসেবে কাজ করেছিল।
এরপর দুই বাহিনীর ক্ষমতার লড়াই ২০২৩ সালের এপ্রিলে পূর্ণমাত্রার যুদ্ধে রূপ নেয়। এই দ্বন্দ্ব জাতিকে পতনের দ্বারপ্রান্তে ঠেলে দেয়।
চলমান সংঘাতে হাজার হাজার মানুষের প্রাণহানি এবং লাখ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। ইতোমধ্যেই ভয়াবহ মানবিক সংকট আরও গভীর হয়েছে।
বিদেশি সম্পৃক্ততার ক্রমবর্ধমান প্রতিবেদন, বিশেষ করে গণহত্যার জন্য অভিযুক্ত আরএসএফের প্রতি সংযুক্ত আরব আমিরাতের সমর্থন – আফ্রিকান দেশটি কেন বহিরাগত শক্তির জন্য এতো কৌশলগত মাঠ হয়ে উঠেছে, সেটি এক গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন।
ইরানের মেহের নিউজ এজেন্সির সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে সুদানের বিশ্লেষক নাসের ইব্রাহিম দেশের সাম্প্রতিক ঘটনাবলী নিয়ে আলোচনা করেছেন।
আলোচনার মধ্যে রয়েছে- সাম্প্রতিক গণহত্যার শিকার আল-ফাশির শহরের পতন, ক্রমবর্ধমান মানবিক সংকট এবং দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বিদেশি শক্তির ক্রমবর্ধমান সম্পৃক্ততা।
সাক্ষাৎকারটি তুলে ধরা হলো:
প্রশ্ন: আল-ফাশিরের পতন গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রতীক হয়ে উঠেছে। মাত্র তিন দিনে জাতিগত নির্মূল অভিযানে ১৫০০ জনেরও বেশি বেসামরিক লোক নিহত হয়েছে। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই ঘটনাগুলো কেবল অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের ফলাফল নয়, বরং বিদেশি শক্তিগুলির প্রভাব রয়েছে। আপনি কি এই সংকটের অভ্যন্তরীণ মূল এবং সুদানের সাম্প্রতিক ঘটনাবলী গঠনে বহিরাগত খেলোয়াড়দের ভূমিকা সম্পর্কে বিস্তারিত বলতে পারেন?
নাসের ইব্রাহিমের উত্তর: ‘হ্যাঁ, আল-ফাশির র্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেস (আরএসএফ)-এর হাতে পড়েছে। দুঃখের বিষয় অনেক বেসামরিক মানুষ প্রাণ হারিয়েছে এবং যা ঘটছে তা জাতিগত নির্মূলের সমান – ধর্ম, ভাষা এবং ত্বকের রঙের কারণে মানুষ হত্যা করা হচ্ছে। আরএসএফ, যাকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে বর্ণনা করা যেতে পারে, তারা সংযুক্ত আরব আমিরাতের সমর্থিত। এই গোষ্ঠী গণহত্যা চালাচ্ছে। ইসরায়েলি সরকারও জড়িত, পাশাপাশি লিবিয়ায় জেনারেল হাফতারের বাহিনী এবং মধ্য আফ্রিকার আরএসএফকে সমর্থনকারী চাদিয়ান সরকারও জড়িত।’
‘এই ট্র্যাজেডি কেবল আল-ফাশিরের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয় – সুদানের অন্যান্য অংশেও একই রকম নৃশংসতা ছড়িয়ে পড়ছে। দেশটির গতিপথে অভ্যন্তরীণ এবং বহিরাগত উভয় পক্ষই ধ্বংসাত্মক ভূমিকা পালন করেছে। পূর্বে আমি উল্লেখ করেছি, সুদানে একটি কাঠামো চুক্তি ছিল, যা সেনাবাহিনীর ওপর চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছিল আরএসএফ। কিন্তু সেনাবাহিনী তা প্রত্যাখ্যান করে। প্রতিক্রিয়ায় সংযুক্ত আরব আমিরাত একটি অভ্যুত্থানের মাধ্যমে আরএসএফকে ক্ষমতায় আনতে চেয়েছিল। সেনাবাহিনী প্রতিরোধ করেছিল – যার ফলে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়।’
‘২০২৩ সাল থেকে সুদান এক ভয়াবহ সংঘাতে জর্জরিত – একটি সত্যিকারের মানবিক ট্র্যাজেডি। আরএসএফ আরব শ্রেষ্ঠত্ববাদী মতাদর্শে বিশ্বাসী, অ-আরব সুদানিদের রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক অধিকারবিহীন সংখ্যালঘু হিসেবে দেখে। মূলত এই যুদ্ধের সূত্রপাত আরএসএফের সুদানকে আরবীকরণ করার প্রচেষ্টা থেকে। এটি একটি এজেন্ডা, যা সুদানের সেনাবাহিনী এখনো প্রতিরোধ করে চলেছে।’
প্রশ্ন: কেন সুদান বিদেশি হস্তক্ষেপকারী শক্তির কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে?
নাসের ইব্রাহিমের উত্তর: সুদানে বিদেশি শক্তির, বিশেষ করে সংযুক্ত আরব আমিরাতের জড়িত থাকার বিষয়টি ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠছে। বিপুল সংখ্যক ড্রোন আরএসএফ-এর হাতে পড়েছে, যা সাম্প্রতিক যুদ্ধগুলোতে তারা ব্যবহার করেছে।
‘আরব আমিরাতের আগ্রাসী নীতির পেছনের একটি মূল কারণ হলো, তাদের ইসলাম-বিরোধী এজেন্ডা। দেশটি মূলত পশ্চিমা শক্তিগুলোর নির্ধারিত একটি মিশন গ্রহণ করেছে – এই অঞ্চলে ইসলামী আন্দোলনগুলোকে দমন করার জন্য।’
‘আরেকটি উদ্দেশ্য হলো, সুদানের বিশাল সোনার খনিগুলোর ওপর নিয়ন্ত্রণ – আফ্রিকার সবচেয়ে বেশি অব্যবহৃত সম্পদগুলোর মজুদের একটি। এর বাইরে, সংযুক্ত আরব আমিরাতের পদক্ষেপগুলো সুদানকে ‘আরবীকরণ’ করার বৃহত্তর লক্ষ্যও বটে; দেশের পরিচয় পুনর্গঠনের লক্ষ্যে একটি আদর্শিক ও রাজনৈতিক প্রকল্প চালানো হচ্ছে।’
‘আরব স্বার্থের কথিত রক্ষক হিসেবে নিজেকে উপস্থাপন করা আরব আমিরাত বাস্তবে জাতিগত নির্মূল এবং জনসংখ্যাতাত্ত্বিক প্রকৌশলে অবদান রেখেছে। এর লক্ষ্য হলো, সুদানের প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর আধিপত্য বিস্তার করা এবং সেখানে তাদের প্রভাব বিস্তার করা। তবে সংযুক্ত আরব আমিরাত একা কাজ করছে না, পশ্চিমা শক্তি এবং ইসরায়েলি সরকারও এই কাজের সঙ্গে জড়িত।’
‘সুদানের ট্র্যাজেডিকে একটি বৃহত্তর আঞ্চলিক কৌশলের অংশ হিসেবে দেখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। লিবিয়া, তিউনিসিয়া, লেবানন, ইরাক এবং ইয়েমেনেও একই ধরণের কৌশল দেখা গেছে। বিদেশি হস্তক্ষেপগুলো বিভক্তি এবং অভ্যন্তরীণ বিভাজনের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় সরকারগুলোকে দুর্বল করার চেষ্টা করেছে। অতএব, সুদান এই চলমান ভূ-রাজনৈতিক প্রকল্পের আরেকটি ধাপে পরিণত হয়েছে।’
প্রশ্ন: সুদানের সাম্প্রতিক ঘটনাবলীর প্রতি আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করেন?
নাসের ইব্রাহিমের উত্তর: সম্প্রতি সুদানজুড়ে একটি জনপ্রিয় স্লোগান ছড়িয়ে পড়েছে: ‘সুদান ছাড়া সুদানের আর কোন বন্ধু নেই।’
‘এই বাক্যাংশের পেছনের বার্তাটি একটি বেদনাদায়ক সত্যকে প্রতিফলিত করে – কোনো সরকারই সুদানকে সত্যিকার অর্থে সমর্থন করে না। সাম্প্রতিক নৃশংসতার প্রতি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতিক্রিয়া মূলত মিডিয়া কভারেজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ, কোনো গুরুতর রাজনৈতিক বা মানবিক পদক্ষেপ নেই।’
‘তবে আরএসএফ-এর প্রধানকে সন্ত্রাসী সংগঠনের নেতা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হলে কূটনৈতিক গতিশীলতা বদলে যেতে পারে। এর ফলে তার রাজনৈতিক বিচ্ছিন্নতার মতো ইতিবাচক অগ্রগতি হতে পারে। আল-ফাশিরের গণহত্যা গাজায় যা ঘটছে, তা প্রতিফলিত করে। মনে হচ্ছে, সুদানের অপরাধীদের প্রতি বিশ্বের প্রতিক্রিয়া গাজায় হত্যাকাণ্ডের প্রতি তাদের প্রতিক্রিয়ার মতোই নীরব থাকবে।’
‘ইতোমধ্যেই, বিশেষ করে পশ্চিমা বিশ্বে নাগরিক সমাজের সংগঠনগুলো (এনজিও) সংযুক্ত আরব আমিরাতের জড়িত থাকার বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে শুরু করেছে এবং নিষেধাজ্ঞার আহ্বান জানিয়ে আন্তর্জাতিক প্রচারণার প্রাথমিক লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। এর থেকে বোঝা যাচ্ছে যে, সুদান সংকটে সংযুক্ত আরব আমিরাতের ভূমিকা শেষ পর্যন্ত তাদের অবস্থানকে দুর্বল করে দেবে, যা দীর্ঘমেয়াদে এটিকে একটি পরাজিত খেলোয়াড় হিসেবে চিহ্নিত করবে। দুর্ভাগ্যবশত ইরানকে যেমন অন্যায্যভাবে লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছে, সুদানও একই পরিণতির মুখোমুখি – উভয় দেশই প্রতিরোধ এবং বহিরাগত শত্রুতার নির্ধারিত ভাগ্য ভাগ করে নিচ্ছে।’