
কৃষিপ্রধান বাংলাদেশের মোট শ্রমশক্তির প্রায় ৩৯ শতাংশ কৃষিকাজে নিয়োজিত। কৃষি উৎপাদনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ হলো সার। নীতিমালা ও তদারকির দুর্বলতায় ফায়দা লুটে নিচ্ছে সার সরবরাহের দায়িত্বে থাকা পরিবহন ঠিকাদার ও ডিলাররাসহ নানান পর্যায়ের ব্যবসায়ীরা। কৃষক ও ব্যবসায়ীদের জিম্মি ও অবৈধভাবে সার মজুত করে সারের বাজারে ডিলাররা সৃষ্টি করছে কৃত্রিম সংকট। বছরে হাজার হাজার কোটি টাকার ভর্তুকি দিলেও সুবিধা সঠিকভাবে পাচ্ছে না কৃষক। সিন্ডিকেটের কারণে অতিরিক্ত দামে সার কিনতে হচ্ছে কৃষকদের। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সাধারণ কৃষক, প্রভাব পড়ছে সামগ্রিক অর্থনীতিতে। এবার ঠিকাদার ও ডিলারদের সার সিন্ডিকেট ভেঙে দিতে কঠোর পদক্ষেপ নিচ্ছে সরকার।
বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার ডিলার সিন্ডিকেট ভাঙতে ‘সার ডিলার নিয়োগ ও সার বিতরণ সংক্রান্ত সমন্বিত নীতিমালা-২০০৯’ সংশোধন করার উদ্যোগ নিয়েছে। দরপত্র প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা আনা, বিএডিসি-বিসিআইসি আলাদা ডিলার ব্যবস্থা তুলে দেওয়া, ডিলারের সংখ্যা বাড়ানোসহ নানা পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে নতুন নীতিমালায়। এতে শত শত কোটি টাকার সাশ্রয় হবে, ভর্তুকির চাপ কমবে এবং কৃষকরা সাশ্রয়ী দামে নিরবচ্ছিন্ন সার পাবেন বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা। সারাদেশের মাঠ পর্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপ করে বিদ্যমান পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে বেশ কিছু সিদ্ধান্ত নিচ্ছে কৃষি মন্ত্রণালয়। এ বিষয়ে একটি বৈঠক করেছে কৃষি মন্ত্রণালয়।
জানা যায়, আগে একেক দেশের একই সারের জন্য একাধিক দরদাতা ভিন্ন ভিন্ন দরে সরবরাহের সুযোগ পেত। এতে সরকারকে টনপ্রতি ২০ থেকে ১৫০ মার্কিন ডলার পর্যন্ত অতিরিক্ত গুনতে হতো। বর্তমান সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে শুধু সর্বনিম্ন দরদাতা প্রতিষ্ঠানকে কার্যাদেশ দেওয়া হচ্ছে।
আবার ডিলাররা সবধরনের সার বিতরণের দায়িত্ব নিত না। কোনো ডিলার ইউরিয়া সার তো কোনো ডিলার নন ইউরিয়া সার। এতে কৃষককে পৃথক পৃথক স্থান থেকে সার সংগ্রহ করতো হতো। তবে এখন এই বিভাজনের সুরাহা করতে যাচ্ছে সরকার। ভবিষ্যতে এক জায়গায় সব ধরনের সার পাওয়া যাবে। বিএডিসি (বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন) ও বিসিআইসি (বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ড্রাস্ট্রিজ কর্পোরেশন) ডিলাররা এখন থেকে ‘সার ডিলার’ হিসেবে বিবেচিত হবেন। পাশাপাশি যেসব ডিলার অনিয়মের মাধ্যমে অস্থিরতা সৃষ্টির চেষ্টা করছেন তাদের লাইসেন্স বাতিলের কথাও ভাবছে সরকার।
সাধারণত কয়েকজন মিলে সিন্ডিকেট করে একটি দরপ্রস্তাব করে কাজ ভাগাভাগি করে নেয়। সিন্ডিকেটের কারণে সর্বনিম্ন দরপ্রস্তাব নিয়ে ডিলাররা কারসাজি করে। সেই সুযোগ আর রাখছে না সরকার। এখন থেকে বাজারদর যাচাই করে সর্বনিম্ন হার নির্ধারণ করে দেবে সরকার। সেই দরের ওপর প্রস্তাব করে সার সংগ্রহ করতে হবে। এতে সরকারের বিপুল অর্থের সাশ্রয় হবে বলে ধারণা করছে সরকার। সারের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টির পাঁয়তারা করলে ওই প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেবে সরকার।
এ বিষয়ে কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. মোহাম্মদ এমদাদ উল্লাহ মিয়ান ইত্তেফাক ডিজিটালকে বলেন, নীতিমালা সংশোধন বিষয়টি খসড়া পর্যায়ে রয়েছে। এটি দ্রুত কার্যকর করা হবে। তবে এই নীতিমালার আলোকে বাস্তবায়ন করা গেলে সার বিতরণ ও কৃষকের স্বার্থ সুরক্ষায় আমূল পরিবর্তন আসবে। আমাদের লক্ষ্য হল, নিরবচ্ছিন্নভাবে কৃষকের কাছে সার পৌঁছানো।
জানা গেছে, দুই দশক আগেও কৃষিতে ভর্তুকি ছিল দেড় থেকে দুই হাজার কোটি টাকা। সেই ভর্তুকির অর্থ গত অর্থবছরে ২৫ হাজার কোটি টাকায় উন্নীত হয়েছে। গত ১৬ অর্থবছরে প্রায় দেড় লাখ কোটি টাকার ভর্তুকি দেওয়া হয়েছে, যার বেশির ভাগই কৃষকের কাছে পৌঁছায়নি। ফলে কৃষকের স্বার্থ উপেক্ষিত থেকেছে।
বর্তমানে দেশে ১০ হাজার ৮১৪টি ডিলারের প্রতিষ্ঠান রয়েছে। ডিলার সিন্ডিকেট থেকে সারের বাজারকে মুক্ত করতে বাড়ানো হবে ডিলারের সংখ্যা। এতে কোনো ডিলার সিন্ডিকেটের মাধ্যমে চড়া দামে সার বিতরণের সুযোগ থাকবে না। কোনো সিন্ডিকেটের কাছে সারের বাজার জিম্মি না থাকে তা মাথায় রেখেই নেওয়া হয়েছে এই পদক্ষেপ।