
বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটের ডেঙ্গু বিশেষায়িত ওয়ার্ডের ১৮ নম্বর বেডে শুয়ে আছে সাত বছরের সুমাইয়া। সুমাইয়াকে নিয়ে মা শারমিন এসেছেন মিরপুর-১ থেকে। তিনি জানান, মেয়েকে যখন হাসপাতালে আনি তখন মেয়ের জ্বর তেমন ছিল না; কিন্তু বমি ছিল, হাসপাতালে আসার পর জানতে পারি মেয়ের ডেঙ্গু হয়েছে। আইসিইউতে থাকতে হয়েছে চার দিন; এরপর ওয়ার্ড আছি আজ পাঁচ দিন ধরে, রক্তের প্লাটিলেট কম; তবে ভালোর দিকে।
একই অবস্থা ১০ মাস বয়সি সোহাগের। গত সোমবার থেকে বমি শুরু হয়, এরপর জ্বর, পাতলা পায়খানা। জ্বর ছিল ১০২ ডিগ্রি। এরপর হাসপাতালে এনে তাকে ভর্তি করা হয়। শিশুটি এখনো ঠিকমতো খেতে পারছে না। গত ছয় দিন ধরে ১৭ নম্বর বেডে ভর্তি আছে ১২ বছরের গালিভ। এই শিশুটিও বমি আর জ্বর নিয়ে হাসপাতালে আসে, এরপর এনএস-১ পরীক্ষায় শনাক্ত হয় ডেঙ্গু পজিটিভ। কল্যাণপুর দক্ষিণ পাইকপাড়া থেকে মা ফারজানা এসেছেন ছেলে গালিভকে নিয়ে।
চলতি বছর এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত ভর্তি রোগীর ২২ শতাংশই শিশু। এসব শিশুর অনেকেই হাসপাতালে আসছে গুরুতর অবস্থায়। দেরিতে হাসপাতালে আসার ফলে রোগীর অবস্থা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। তাই শিশুর জ্বর হলে দ্রুত এনএস-১ পরীক্ষার পর চিকিত্সকের পরামর্শ নেওয়ার তাগিদ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞ চিকিত্সকরা। তারা বলছেন, সময়মতো হাসপাতালে এলে ৯৫ শতাংশ শিশু ডেঙ্গু রোগী সুস্থ হয়ে যায়।
শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউট থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ২২ অক্টোবর পর্যন্ত হাসপাতালটিতে ভর্তি হয়েছে ৪৮৭ জন শিশু ডেঙ্গু রোগী। এর মধ্যে মৃত্যু হয়েছে পাঁচ জনের। এই হাসপাতালে ডেঙ্গুতে মৃত্যু হওয়া শিশুদের বিষয়ে হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক ড. মো. জাফর ইকবাল ইত্তেফাককে বলেন, সঠিক সময়ে হাসপাতালে এলে ৯৫ শতাংশ শিশু সুস্থ হয়ে যায়। ডেঙ্গুতে যে বাচ্চাগুলোর মৃত্যু হয়েছে, তাদের ডেঙ্গুর সঙ্গে অন্য রোগের জটিলতাও ছিল। যেমন—একটা বাচ্চার থ্যালাসেমিয়া ছিল, এক জনের লিভারের সমস্যা ছিল, অন্য একটা বাচ্চার কিডনি ফেইলিউর ছিল। রোগী দেরিতে হাসপাতালে এলে এবং তার যদি কমপ্লিকেশন থাকে সে ক্ষেত্রে রোগীর অবস্থা খারাপ হয়ে যায়।
শিশু হাসপাতালে পাঁচ বছরে ডেঙ্গুতে ভর্তি ও মৃত্যু :হাসপাতালে শিশু ডেঙ্গু রোগীর তথ্য থেকে জানা যায়, ২০১৯ সালে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ১,৪৫০ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়, এর মধ্যে ১৮ জনের মৃত্যু হয়। ২০২০ সালে ৯৬ জন ভর্তি হয়, এর মধ্যে মৃত্যু হয় এক জনের। ২০২১ সালে ১,১০৭ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়, এর মধ্যে মৃত্যু হয় ১৭ জনের। আর ২০২২ সালে ভর্তি হয় ১,২৫২ জন, এর মধ্যে মৃত্যু হয় ২২ জনের। ২০২৩ সালে সর্বোচ্চ সংখ্যক ২০৩৩ জন শিশু ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়ে মারা যায় ২৩ জন। আর ২০২৪ সালে ভর্তি হয় ৮০৬ জন এবং মৃত্যু হয় ১১ জনের। আর চলতি বছর ২০২৫ সালের ২২ অক্টোবর পর্যন্ত ভর্তি ৪৮৭ জনের মধ্যে মৃত্যু হয়েছে পাঁচ জনের।
বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক ড. মো. জাফর ইকবাল ইত্তেফাককে বলেন, ‘রোগীরা আসে সাধারণত জ্বর, গায়ে ব্যথা, বমি বমি ভাব, পেটে ব্যথা, শরীর ফুলে যাওয়া, পেটে পানি, ফুসফুসে পানি নিয়ে, কিছু রোগী আসে র্যাশ নিয়ে। এ ধরনের কোনো রোগী যখন আমাদের বহির্বিভাগে আসে তখন আমরা ডেঙ্গুটা পরীক্ষা করিয়ে নিই। এতে ডেঙ্গু পজিটিভ এলে তখন কিছু নরমাল রোগী থাকে যাদের আমরা বাসায় থেকে চিকিত্সা নিতে বলি; আর কিছু রোগী আসে যে বাচ্চাদের শরীর ঠান্ডা হয়ে যায়, প্রেসার কমে যায়, পালস কমে যায়, ইউরিন আউটপুট কম হয়—ঐসব শিশুকে আমরা ভর্তি করিয়ে নিই। এর মধ্য থেকে কিছু বাচ্চাকে আইসিইউতে ভর্তি রাখতে হয়। যারা বাসায় চিকিত্সা নেবে তাদের জন্যে আমাদের উপদেশ থাকে—রোগীর শরীর মুছে দেওয়া, জ্বর থাকলে প্যারাসিটামল খাওয়াতে হবে, ঘন ঘন লিকুয়িড খাবার খাবে, আর বাচ্চার যদি ওয়ার্নিং সাইনগুলো থাকে তাহলে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে আসবেন। বাচ্চার যদি বমি বা পাতলা পায়খানা হয়, খিঁচুনি দেখা দেয়, যদি জন্ডিস দেখা দেয়, তাহলে হাসপাতালে নিয়ে আসবেন।’
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. আবু জাফর বলেন, এ বছর ডেঙ্গুর প্রকোপ বেশি বরিশাল ও ঢাকা বিভাগে। এরপরে রয়েছে চট্টগ্রামে, রাজশাহীতে আছে, তবে খুব কম। ঢাকায় বেশি মানুষের বসবাস, সে কারণেই হয়তো ঢাকায় আক্রান্তের সংখ্যাও বেশি। তিনি বলেন, মশা নিধনের কাজ স্বাস্থ্য অধিপ্তরের নয়, এটা সিটি করপোরেশনের কাজ। এ কাজের সমন্বয় অতি জরুরি, কিন্তু তা করা হচ্ছে না। তিনি বলেন, জনসচেতনতা বাড়াতে হবে, মশারি লাগিয়ে ঘুমাতে হবে, এছাড়া জ্বর হলে চিকিত্সকের শরণাপন্ন হতে হবে। তিনি বলেন, আমরা যত ব্যবস্থাই নিই না কেন, জনগণ সচেতন না হলে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে আনা দুষ্কর। ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ে এই মৌসুমে। গত বছরের এই সময়টাতে ডেঙ্গু বেড়েছিল। তবে গত বছরের তুলনায় এ বছর এ সময়ে ডেঙ্গুর প্রকোপ বেশি।
বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ: রাতে-দিনে ঘুমানোর সময় মশারি লাগিয়ে নিন, শিশুকে ফুল হাতের জামা ও পায়জামা পরান। শিশুকে অনুজ্জ্বল কাপড় পরান, কারণ উজ্জ্বল কাপড়ে মশা আকৃষ্ট হয়। ডেঙ্গু আক্রান্ত শিশুদের ক্ষেত্রে লক্ষণগুলো সাধারণ সর্দি-কাশির মতো মনে হতে পারে, তবে জ্বর এবং ত্বকের ওপর ফুসকুড়ি বা লাল দাগ দেখা গেলে সতর্ক হওয়া জরুরি। শিশুদের বিশেষ করে ছোট শিশুদের ডেঙ্গু এবং এর জটিলতা (যেমন তীব্র ডেঙ্গু বা ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার) হওয়ার ঝুঁকি বেশি। প্রথমত দিন শিশুদের মধ্যে প্রায়ই একটানা উচ্চ জ্বর দেখা যায়, যা বাবা-মায়েরা সাধারণ সর্দি বা শ্বাসযন্ত্রের সংক্রমণ ভেবে ভুল করে থাকেন। জ্বর অব্যাহত থাকে এবং শিশুর ঘাড়ে, পেটে, বাহুতে ও পায়ে ফুসকুড়ি বা ছোট লাল দাগ দেখা যেতে পারে। কিছু ক্ষেত্রে ডেঙ্গু মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে। ডেঙ্গু জ্বরের নির্দিষ্ট কোনো চিকিত্সা নেই। প্রচুর পরিমাণে তরল পান করে এবং পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিয়ে শরীরকে পানিশূন্যতা থেকে রক্ষা করতে হয়।