
সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হওয়ার পর ভিকটিমরা কেবল শারীরিকভাবে পঙ্গুত্ববরণই করছেন না, তাদের পরিবারের উপর নেমে আসছে তীব্র আর্থিক সংকট। দুর্ঘটনায় আহতদের চিকিৎসা ব্যয় এতটাই ব্যয়বহুল হয়ে উঠছে যে অনেক পরিবার ঋণগ্রস্ত, নিঃস্ব কিংবা পথে বসতে বাধ্য হচ্ছে।
সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হলে তাদের আর্থিক ক্ষতিপূরণ ও চিকিৎসা সহায়তার জন্য সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ তে একটি পৃথক আর্থিক সহায়তা তহবিল এবং ট্রাষ্টি বোর্ড গঠন করার জন্য মোটরযান মালিকদের নির্দেশ দেয়া হলেও এখনও তা কাগজে কলমে রয়ে গেছে। ফলে দুর্ঘটনায় আহতরা মোটরযান মালিকদের কাছ থেকে কোনো আর্থিক সহায়তা পাচ্ছেন না। এ কারণে সড়কের যাত্রী ও পথচারীদের দুর্ঘটনা থেকে সুরক্ষার জন্য সড়ক নিরাপত্তা আইন প্রণয়নের দাবি উঠেছে।
রাজধানীর আফতাবনগর এলাকার বাসিন্দা জাহিদুল ইসলাম (৪২) হাতিরঝিল এলাকায় গত জুলাই মাসে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হন। তার এক পা ভেঙ্গে যায়। জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানে (নিটোর) দীর্ঘ এক মাস থেকে চিকিৎসা শেষে বাসায় ফিরেছেন। চিকিৎসকরা তার পায়ে অপারেশনের মাধ্যমে দুই হাড়ে রড ও স্ক্রু দিয়ে হাড় দুটির ভাঙ্গা অংশ প্রতিস্থাপন করেন। এক মাস পর আবার হাসপাতালে আসতে হবে। আবারও অপারেশন করা হবে বলে চিকিৎসকরা জানিয়েছেন। সরকারি হাসপাতাল বলে তার চিকিৎসা ব্যয় কিছুটা কম। সব মিলিয়ে জাহিদুলের এখন পর্যন্ত ৭০/৮০ হাজার টাকা ব্যয় হয়েছে।
জাহিদুল বলেন, বেসরকারি হাসপাতালে এই অপারেশন করলে খরচ হত ৪ লাখ থেকে ৫ লাখ টাকা। সরকারি হাসপাতালে একটু সময় লাগে।
ফুড সার্ভিস ডেলিভারিম্যান জাহিদুলের দুর্ঘটনার পর এখন পুরো পরিবার পথে বসেছে। ইতোমধ্যে তিনি আফতাবনগরের বাসা ছেড়ে দিয়ে কম ভাড়ায় বনশ্রী এলাকায় সাবলেটে উঠেছেন।
সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে জাহিদুলের মত অবস্থা সারাদেশের চিত্র এটি। রাজধানীর জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানে একবার সরেজমিনে গেলেই এ চিত্র চোখে পড়ে। কারও দুই পা, কারও এক পা কাটা। আবার কারও দুই হাত বা এক হাত কাটা। অনেকের হাত-পা না কাটলেও লোহার রডবিদ্ধ অবস্থায় কাতরাচ্ছে বিছানায় ও মেঝেতে। দুর্ঘটনা এলোমেলো করে দিয়েছে অনেকের জীবন।
পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি পঙ্গু হয়ে যাওয়ায় ভবিষ্যৎ নিয়ে দিশেহারা অনেক পরিবার। মাসের পর মাস ওষুধপত্র কেনাসহ চিকিৎসার ব্যয় বহন করতে না পেরে দুর্বিষহ জীবনযাপন করছে কেউ কেউ। আহত রোগীদের আর্তনাদে হাসপাতালের জরুরি বিভাগের পরিবেশ ভারী থাকে সবসময়। দুঃখ-দুর্দশার যেন শেষ নেই সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ও আহত ব্যক্তির স্বজনদের।
চিকিৎসা শেষে আহত স্বামীকে হুইল চেয়ারে করে নিয়ে হাসপাতাল থেকে বের হওয়ার সময় জানতে চাইলে স্ত্রী শারমিন বেগম বলেন, ‘ডাক্তাররা বলছেন, ওকে দীর্ঘ সময় ধরে ফিজিওথেরাপি করাতে হবে। প্রতিদিন ২-৩ হাজার টাকা খরচ হচ্ছে। আমাদের সঞ্চয় ফুরিয়েছে, স্বর্ণালঙ্কার বিক্রি করেছি, এখন আত্মীয়-স্বজনের কাছ থেকে ধার করছি।’ স্বামীর দুর্ঘটনায় আহতের পর কোনো ক্ষতিপূরণ পেয়েছেন কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আহত হলে ক্ষতিপূরণ কেউ দেয় কি না আমারা জানা নাই। তবে ক্ষতিপূরণ দেয়া উচিত। এজন্য সড়ক নিরাপত্তা আইন থাকলে, ওই আইনে ক্ষতিপূরণ দাবি করতে পারতাম।’
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, সড়ক দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত এক ব্যক্তির গড়ে চিকিৎসা খরচ দাঁড়ায় ৫ থেকে ১০ লাখ টাকা। দুর্ঘটনার পরপরই জরুরি অস্ত্রোপচার, আইসিইউ সেবা, ওষুধপত্র এবং দীর্ঘমেয়াদি থেরাপি সব মিলিয়ে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারের পক্ষে এ খরচ সামলানো প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে।
বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ সমিতির তথ্য বলছে, দেশে প্রতি বছর প্রায় ২০-২৫ হাজার মানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায়। আহত হন আরও অন্তত ৩৫ হাজার। এদের বড় অংশই কর্মক্ষম বয়সী। আহতদের অনেকে পঙ্গুত্ববরণ করায় পরিবারগুলো দীর্ঘস্থায়ী দারিদ্র্যের ফাঁদে পড়ে যাচ্ছে।
আইনি সহায়তা ও ক্ষতিপূরণ জটিলতা:
আইন অনুযায়ী, দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ এ ক্ষতিপূরণের বিধান থাকলেও বাস্তবে ভিকটিম পরিবারের হাতে পৌঁছায় না। মামলা প্রক্রিয়া জটিল ও দীর্ঘমেয়াদি হওয়ায় অধিকাংশ পরিবার আদালতে না গিয়েই ব্যক্তিগতভাবে চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে বাধ্য হয়।
রাজধানীর মিরপুরের উত্তর বিশিল এলাকার বাসচালক সাহেব আলী দুর্ঘটনায় পঙ্গু হওয়ার পর বলেন, বাস মালিকের কাছ থেকে ১ টাকাও ক্ষতিপূরণ পাইনি। মিরপুরের বাস মালিক সমিতির কাছে গিয়েছিলাম, কোনো সহায়তা পাইনি। এখন এলাকায় চায়ের দোকান করে সংসার চালাই।
বিশেষজ্ঞদের মতামত:
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, সড়ক দুর্ঘটনায় আহতদের জন্য কোনো জাতীয় পুনর্বাসন তহবিল গঠন করা জরুরি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. সেলিনা হক বলেন, প্রতিদিন এত মানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তাদের জন্য স্বাস্থ্য বীমা বা সরকারি সহায়তা না থাকলে পরিবারগুলো ভেঙে পড়বে। এটি জাতীয় অর্থনীতির ওপরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
সড়ক দুর্ঘটনা শুধু প্রাণহানিই ঘটাচ্ছে না, বেঁচে থাকা আহতদের দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসা ব্যয় বহনের কারণে হাজারো পরিবার নিঃস্ব হচ্ছে। তাই ক্ষতিপূরণ নিশ্চিত করা, সরকারি পুনর্বাসন তহবিল গঠন এবং চিকিৎসা খাতে ভর্তুকি প্রদানের দাবি জোরালো হচ্ছে।
আর্থিক তহবিল গঠন:
সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ এর ৫২ ও ৫৩ ধারা অনুযায়ী একটি অর্থ সহায়তা তহবিল গঠন এবং তার কার্যক্রম পরিচালনার জন্য একটি বোর্ড অব ট্রাস্টি গঠন করার কথা বলা হয়েছে । এ অনুযায়ী ২০২১ সালে অর্থ মন্ত্রণালয় সড়ক দুর্ঘটনায় ভুক্তভোগীদের ক্ষতিপূরণ বা চিকিৎসা খরচ বাবদ তহবিল চালুর জন্য একটি বোর্ড গঠন করে । ২০২২ সালে এ সংক্রান্ত একটি বিধিমালা প্রণয়ন করে তার অনুমোদনের জন্য সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগে পাঠানো হয় । ওই পর্যন্তই শেষ। এরপর থেকে অর্থ মন্ত্রণালয়ের পাঠানো সেই ফাইল চাপা পড়ে আছে। এরই মধ্যে সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ যাত্রী ও পথচারীদের কোনো আইনি সুরক্ষা দিতে পারছে না বলে বিভিন্ন মহল থেকে দাবি উঠেছে। এই আইনে পরিবহন মালিকদের সুরক্ষা দেয়া হচ্ছে। এ থেকে দাবি উঠেছে, যাত্রী ও পথচারীদের জন্য সড়ক নিরাপত্তা আইন প্রণয়ন করে তা কার্যকর করা হোক।
এ ব্যাপারে নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা) এর ভাইস চেয়ারম্যান লিটন এরশাদ বলেন, সড়ক নিরাপত্তা আইনে প্রতিটি পরিবহনের যাত্রীর বীমা বাধ্যতামূলক করতে হবে। একটি বাস, ট্রাক, মাইক্রোবাস, প্রাইভেট কারসহ অন্যান্য পরিবহন গাড়ির রেজিস্ট্রেশন করার সময় যাত্রীদের বীমার বিষয়টি বাধ্যতামূলক রাখতে হবে। এছাড়া আহতদের জন্য চিকিৎসা ব্যয় নির্ধারণ করতে একটি কমিটি গঠন করা হবে। এটা বিআরটিএ’র অধীন প্রতিটি জেলায় রোড সেফটি কাউন্সিলের সাথে সমন্বয় করে এই কমিটি করা যেতে পারে। কমিটি আহতদের বিষয়টি তদন্ত করে তার চিকিৎসা ব্যয় নির্ধারণ করবে। এই অর্থ ট্রাস্টের পক্ষ থেকে পরিশোধ করবে।