
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের প্রস্তাব অনুসারে ‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫’ বাস্তবায়নে সংসদ নির্বাচনের দিনই গণভোট আয়োজনের চিন্তা করছে সরকার। গণভোটের দিনক্ষণ ও পদ্ধতি নিয়ে এখনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি, তবে সরকার এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশন (ইসি) ও রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করতে পারে বলে সূত্র জানিয়েছে।
ব্যালটে দুটি অংশ থাকবে—একটিতে রাজনৈতিক দলগুলোর সর্বসম্মত প্রস্তাব এবং অন্যটিতে যেসব প্রস্তাবে আপত্তি বা নোট অব ডিসেন্ট রয়েছে, সেগুলো। ভোটাররা প্রতিটি অংশে আলাদাভাবে ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ ভোট দিতে পারবেন।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সূত্রে জানা গেছে, জুলাই সনদ বাস্তবায়নে সরকারকে দ্রুত সুপারিশ দিতে যাচ্ছে কমিশন। এর ভিত্তিতেই সরকার ‘জুলাই আদেশ’ জারি করে গণভোটের প্রক্রিয়া শুরু করতে পারে।
কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বৃহস্পতিবার যুগান্তরকে বলেন, “রাজনৈতিক দলগুলো আমাদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার দায়িত্ব দিয়েছে। আমরা বিশেষজ্ঞ ও দলের মতামত সমন্বয় করে সরকারের কাছে সুনির্দিষ্ট পরামর্শ দেব।”
১৫ অক্টোবর সনদে স্বাক্ষর
কমিশন জানিয়েছে, আগামী ১৫ অক্টোবর বিকেলে জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় রাজনৈতিক দলগুলো জুলাই সনদে স্বাক্ষর করবে। অনুষ্ঠানে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ও কমিশনের সভাপতি ড. মুহাম্মদ ইউনূস উপস্থিত থাকবেন। তবে সব দল সনদে স্বাক্ষর করবে কি না, তা এখনও অনিশ্চিত।
বৃহস্পতিবার কমিশনের বৈঠক শেষে পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, সনদ বাস্তবায়নের উপায় নিয়ে বিশেষজ্ঞ মতামত ও রাজনৈতিক দলগুলোর প্রাপ্ত অভিমত বিশ্লেষণ করে চূড়ান্ত সুপারিশ সরকারের কাছে জমা দেওয়া হবে।
৮৪ দফা প্রস্তাব
‘জুলাই সনদে’ মোট ৮৪টি প্রস্তাব রয়েছে। এর মধ্যে ২৯টি নির্বাহী আদেশে, ২১টি রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশে এবং ৩৪টি সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করতে হবে। সংবিধান সংশোধনের বিষয়ে দলগুলোর মতভিন্নতা থাকায় কমিশন সনদ ও বাস্তবায়ন কাঠামো আলাদা করে সরকারের কাছে উপস্থাপন করবে।
দলগুলোর অবস্থান
প্রাথমিকভাবে ৩২টি রাজনৈতিক দল আলোচনায় অংশ নিলেও শেষ পর্যন্ত সংখ্যা নেমে আসে ৩০-এ। বিএনপি, জামায়াতে ইসলামি ও এনসিপি সবচেয়ে গুরুত্ব পেয়েছে। গণভোটের সময় নিয়ে দলগুলোর মতভিন্নতা রয়েছে।
বিএনপি চায় সংসদ নির্বাচনের দিনেই গণভোট হোক। তাদের যুক্তি, এতে সময় ও ব্যয় সাশ্রয় হবে। জামায়াতে ইসলামি চায় নভেম্বরে গণভোট হোক, যাতে জাতীয় নির্বাচন (ফেব্রুয়ারিতে) নিরপেক্ষভাবে অনুষ্ঠিত হতে পারে। তাদের আশঙ্কা—একই দিনে নির্বাচন ও গণভোট হলে ফলাফল প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে। এনসিপি-ও চায় আগে গণভোট অনুষ্ঠিত হোক। শেষ পর্যন্ত ঐকমত্য না হওয়ায় কমিশনকেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার দায়িত্ব দিয়েছে দলগুলো।
নোট অব ডিসেন্ট বা আপত্তি
সনদের ৮৪ দফার মধ্যে ১৪টি প্রস্তাবে আপত্তি দিয়েছে বিভিন্ন দল। সবচেয়ে বেশি আপত্তি বিএনপি ও তার সমমনা দলগুলোর—মোট ৯টি। এর মধ্যে রয়েছে—প্রধানমন্ত্রী, দলীয় প্রধান ও সংসদ নেতা—একই ব্যক্তি না থাকা, সংসদের উচ্চকক্ষে পিআর (আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব) পদ্ধতিতে সদস্য নির্বাচন, এছাড়া রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও রাষ্ট্রের মূলনীতি নিয়েও আপত্তি রয়েছে।
সিপিবি ও বাম জোট ৪টি, জামায়াতে ইসলামি ১টি এবং অন্যান্য ইসলামি দল ২টি বিষয়ে আপত্তি জানিয়েছে। এনসিপি কোনো আপত্তি দেয়নি।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ কমিশনের বৈঠকে বলেন, “যেসব প্রস্তাবে আমরা নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছি, সেগুলো আমাদের নির্বাচনি ইশতেহারে থাকবে। জনগণ যদি আমাদের রায় দেয়, তাহলে ওই প্রস্তাব বাস্তবায়নের বাধ্যবাধকতা থাকবে না।”
বিশেষজ্ঞ প্যানেলের সুপারিশ
শেষ বৈঠকে বিশেষজ্ঞরা সনদ বাস্তবায়নে পাঁচ দফা পরামর্শ দিয়েছেন— সরকার ‘জুলাই আদেশ’ জারি করবে। সেই আদেশের অধীনে গণভোট আয়োজন করা হবে। গণভোটের ব্যালটে দুটি প্রশ্ন থাকবে—সম্মত ও আপত্তিকর প্রস্তাব পৃথকভাবে। সংবিধান সংস্কার পরিষদ ও ১৩তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে সংস্কার বাস্তবায়ন করা হবে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে গণভোটে অনুমোদিত প্রস্তাব সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
আট মাসের কর্মযজ্ঞ
গত বছরের ১১ সেপ্টেম্বর সরকার ছয়টি সংস্কার কমিশন গঠন করে। তাদের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে ২০২৫ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের কাজ শুরু হয়। এখন পর্যন্ত তিন দফায় ৭২টি বৈঠক করেছে কমিশন।
শেষ পর্যন্ত রাজনৈতিক দলগুলো চূড়ান্ত ঐকমত্যে পৌঁছাতে না পারলেও কমিশন বলছে—“গণভোটই হবে জাতীয় ঐক্যের পরীক্ষার মঞ্চ।”