
বাংলাদেশের ইতিহাসে বহুল আলোচিত দুর্নীতি, অর্থপাচার ও ঋণ জালিয়াতির মামলায় ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ অনেকের বিরুদ্ধে এবার ইন্টারপোলের রেড নোটিশ জারির উদ্যোগ নিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। ইতোমধ্যে পুলিশ সদর দপ্তরে একাধিক চিঠি পাঠিয়ে অন্তত ১০ জনের বিরুদ্ধে এই প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।
শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে রেড নোটিশ জারির চিঠিতে দুদক বলছে, ‘মামলার তদন্তকালে জানা যায়, এজাহারনামীয় আসামি শেখ হাসিনা বিদেশে অবস্থান করছেন। ন্যায়বিচারের স্বার্থে তার অবস্থান শনাক্ত করে দেশে ফিরিয়ে এনে আইনের মুখোমুখি করার জন্য বিজ্ঞ আদালত গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছেন। এমন অবস্থায় বিজ্ঞ আদালতের আদেশ, গ্রেপ্তারি পরোয়ানা, এজাহারের কপি, অভিযোগপত্রের কপি এবং পূরণকৃত রেড নোটিশ ফরম সংযুক্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ জানানো হলো।’
জয় ও পুতুলের বিষয়ে পাঠানো চিঠিতেও প্রায় একই কথা বলা হয়েছে। চিঠিতে তিনজনের নাম নাম, এনআইডি নম্বর, বাবা ও মায়ের নাম, পাসপোর্ট নম্বর ও ঠিকানাও দেওয়া হয়েছে।
দুদকের উপপরিচালক ও জনসংযোগ কর্মকর্তা আকতারুল ইসলাম বলেন, ‘অন্যদের রেড নোটিশ জারির চিঠিতেও একই ধরনের তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে।’
দুদক জানিয়েছে, ইন্টারপোলের মাধ্যমে রেড নোটিশ জারি করতে প্রথমে পুলিশ সদর দপ্তর থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব যাবে। পরে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে ইন্টারপোল সদর দপ্তরে আনুষ্ঠানিকভাবে আবেদন পাঠানো হবে। আদালতের অনুমোদনের ভিত্তিতেই এই প্রক্রিয়া এগিয়ে যাচ্ছে।
ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার পরিবারের বিরুদ্ধে একাধিক মামলায় অভিযোগপত্র দাখিল করেছে দুদক। পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পে ছয়টি প্লট জালিয়াতির মামলায় তিনি ও তার ছেলে-মেয়েকে আসামি করা হয়েছে। মামলার অভিযোগ অনুযায়ী, তারা অযোগ্য হয়েও ক্ষমতার প্রভাবে ওই প্লট বরাদ্দ নিয়েছিলেন। এসব মামলায় মোট ২৩ জনকে আসামি করা হয়েছে, যার মধ্যে শেখ হাসিনা একাই ছয়টি মামলায় আসামি। আদালত তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে। গত বছরের ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর থেকে তিনি ভারতে অবস্থান করছেন। ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে, আর মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুলও দেশের বাইরে রয়েছেন।
সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক বেনজীর আহমেদের বিরুদ্ধেও দুর্নীতি ও অবৈধ সম্পদ অর্জনের গুরুতর অভিযোগ রয়েছে। তার বিরুদ্ধে চারটি মামলা করেছে দুদক। অভিযোগ অনুযায়ী, তিনি একাই ৯ কোটি টাকার বেশি অবৈধ সম্পদ অর্জন করেছেন, আর তার স্ত্রী জীশান মীর্জা অর্জন করেছেন ৩১ কোটি টাকার বেশি। তাদের দুই মেয়ের বিরুদ্ধেও অভিযোগ রয়েছে। আদালত ইতোমধ্যে তাদের নামে থাকা বিপুল সম্পদ, ব্যাংক হিসাব, ফ্ল্যাট, শেয়ার এবং শত শত বিঘা জমি জব্দের নির্দেশ দিয়েছে। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে আদালত বেনজীর ও তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে রেড নোটিশ জারির অনুমোদন দিয়েছিল।
সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ ও তার স্ত্রী রুকমিলা জামানের বিরুদ্ধেও ঋণ জালিয়াতি ও অর্থপাচারের অভিযোগ উঠেছে। দুদকের করা মামলায় তাদের বিরুদ্ধে প্রায় ২০ কোটি টাকার ঋণ জালিয়াতির অভিযোগ আনা হয়েছে। পরবর্তী তদন্তে বিদেশে তাদের বিপুল সম্পদ ও ব্যাংক হিসাবের সন্ধান মেলে। যুক্তরাজ্য, আমিরাত ও যুক্তরাষ্ট্রে তাদের শত শত সম্পত্তি রয়েছে বলে অভিযোগে উল্লেখ করা হয়েছে। গত সেপ্টেম্বরে আদালত তাদের বিরুদ্ধেও রেড নোটিশ জারির অনুমোদন দেয়।
চট্টগ্রামভিত্তিক এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাইফুল আলম এবং তার দুই ভাই আব্দুস সামাদ ও মোহাম্মদ আবদুল্লাহ হাসানের বিরুদ্ধেও বড় অঙ্কের ঋণ জালিয়াতি ও মানি লন্ডারিংয়ের অভিযোগ রয়েছে। অভিযোগ অনুযায়ী, তারা রিলায়েন্স ফাইন্যান্স থেকে ১০৪ কোটি টাকার ঋণ জালিয়াতি করে নিজেদের কোম্পানির হিসাবে স্থানান্তর করেছেন। এস আলম সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। ইসলামী ব্যাংকসহ আরও আটটি ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর তাদের বিরুদ্ধে নামে-বেনামে এক লাখ কোটি টাকারও বেশি অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে।