
ডেঙ্গুর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মশাবাহিত আরও একটি রোগ—চিকুনগুনিয়া। চিকুনগুনিয়া ভাইরাসজনিত একটি রোগ, যা সাধারণত এডিস মশার কামড়ের মাধ্যমে ছড়ায়। এই রোগের অন্যতম উপসর্গ—জ্বর ও ভয়ানক গিঁটে ব্যথা। অনেক সময় এই ব্যথা রোগ সেরে যাওয়ার পরও সপ্তাহ বা মাসখানের ধরে থাকতে পারে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ বছর কোনো কোনো জায়গায় ডেঙ্গু-চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত রোগী সমান সমান। তবে ঢাকা ও চট্টগ্রামে সংক্রমণের ব্যাপকতা বেশি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চিকুনগুনিয়া ভাইরাসের নির্দিষ্ট কোনো চিকিৎসা নেই। এটি মূলত এডিস প্রজাতির মশার মাধ্যমে ছড়ায়, বিশেষ করে এডিস এজিপ্টাই মশা, যেটি ডেঙ্গু ও জিকা ভাইরাসও বহন করে। তারা বলছেন, শুধু চিকুনগুনিয়ার কারণে প্রাণসংশয়ের আশঙ্কা নেই বললেই চলে। কিন্তু রোগীর শরীরের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকলে বা একই সঙ্গে অন্য রোগের সংক্রমণ থাকলে—তা প্রাণঘাতী হতে পারে।
এডিস ও চিকুনগুনিয়া ভাইরাসের বাহক স্ত্রী এডিস মশা সারা বছর বংশবিস্তার করতে পারে। তবে এর জন্য তাদের প্রয়োজন পড়ে পরিষ্কার ও আবদ্ধ পানির। আর এ বছর বর্ষাকাল শুরু হওয়ার আগে থেকেই নিয়মিত বৃষ্টি ও রাস্তার বিভিন্ন জায়গায় জলাবদ্ধতাকে ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়ার প্রকোপ বৃদ্ধির কারণ বলে মনে করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
আইইডিসিআরের তথ্য বলছে, ঢাকায় প্রথম পাঁচ মাস, অর্থাৎ ১ জানুয়ারি থেকে ২৮ মে পর্যন্ত ৩৩৭টি নমুনা পরীক্ষা করে ১৫৩টি চিকুনগুনিয়া পাওয়া গেছে। চট্টগ্রামে জুন-জুলাইতে চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ৬৬৯ জন। আর জুনের প্রথম তিন সপ্তাহে ১৭১ নমুনার মধ্যে ১৪০টি পজেটিভ; যা প্রায় ৮২ শতাংশ। এর মধ্যে ৯৮ শতাংশ রোগী ঢাকার। এছাড়া বেসরকারি হাসপাতালে টেস্টের বেশির ভাগই ৩৫৬ নমুনা থেকে ৩১৬টি নমুনা পজেটিভ পাওয়া গেছে। অন্য একটি তথ্য বলছে—জ্বরে আক্রান্তদের ৭০ ভাগের শরীরের চিকুনগুনিয়া ছিল।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে: চিকুনগুনিয়ার ভাইরাসটি খুব দ্রুত ছড়ায় এবং বড় পরিসরে সংক্রমণ ঘটাতে পারে। ফলে এটি এখন একটি গুরুতর স্বাস্থ্যসংকট হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে বলে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। সম্প্রতি চিকুনগুনিয়া ভাইরাস দ্রুত ছড়িয়ে পড়া রোধে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) একটি জরুরি সতর্কতা জারি করেছে। সংস্থাটি আশঙ্কা প্রকাশ করে জানিয়েছে, গত দুই দশক আগে বিশ্ব জুড়ে ছড়িয়ে পড়া মহামারির মতো পরিস্থিতি আবার ফিরে আসতে পারে।
বিশেষজ্ঞরা যা বলছেন: ইমিরেটাস অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ ইত্তেফাককে বলেন, এ বছর ডেঙ্গুর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে চিকুনগুনিয়া ও জিকার সংক্রমণ। এটিও ভাইরাসজনিত ডেঙ্গুর মতোই এডিস মশার কামড়ের মাধ্যমে ছড়ায়। এর মূল লক্ষণ—রোগীর জ্বর বেশি থাকে, বমি বমি ভাব, মুখে রুচি থাকে না। জ্বর দুই/তিন দিনে হয়তো কমে যায়, কিন্তু গিরায় গিরায় ভয়ংকর ব্যথা থাকে। রোগীকে একধরনের পঙ্গু করে ফেলে। এ কারণে অনেকে একে বলে ‘ল্যাংড়া জ্বর’। জ্বর ভালো হওয়ার পর এক-দুই সপ্তাহের মধ্যে ৮০-৯০ ভাগ রোগী সুস্থ হয়ে যায়। তবে কেউ কেউ অনেক বেশি ভোগে।
বিশিষ্ট এই মেডিসিন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক জানান, যাদের চিকুনগুনিয়ার লক্ষণ দেখা দিচ্ছে, তারা চিকিৎসকের পরামর্শ নেবেন। বিশেষ করে যারা বয়স্ক ব্যক্তি, কিংবা হার্টের রোগী, কিডনি কিংবা স্ট্রোকের রোগী, ক্যানসারের রোগী বা গর্ভবতী নারী—তারা যেন চিকিৎসকের পরামর্শ নেন। প্যারাসিটামল জাতীয় ওষুধ খাবেন, না কমলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে। চিকুনগুনিয়া ভোগায় বেশি, তবে একবারে মেরে ফেলে না। এই রোগে মৃত্যুহার একবারেই কম। ডেঙ্গুর মতো, প্লেটেলেট কমা বা রক্ত ক্ষরণের ঝুঁকি থাকে না। তাই বলে অবহেলাও করা যাবে না। প্যারাসিটামল ছাড়া, অন্যকোনো ওষুধ চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া খাবেন না। চার/পাঁচ দিন পর চিকুনগুনিয়ার এন্টিবডি পরীক্ষা করাতে পারেন, তবে অধিকাংশ রোগীর লক্ষণ দেখে এই রোগ শনাক্ত করা যায়। অধ্যাপক ডা. আবদুল্লাহ বলেন, প্রচুর শরবত, পানি, ডাবের পানি খাবে, হালকা ম্যাসাজ, ব্যায়াম করতে পারেন, যদি উন্নতি না হয় তাহলে ফিজিওথেরাপিও নিতে পারে রোগী।
প্রথম তিন দিনে জ্বর না কমলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে: সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণাপ্রতিষ্ঠান—আইইডিসিআর-এর পরামর্শক ডা. মুশতাক হোসেন ইত্তেফাককে বলেন, এ বছর কোনো কোনো জায়গায় ডেঙ্গু এবং চিকুনগুনিয়া সমান সমান। ঢাকাতেও গত বছরের চেয়ে অনেক বেশি হচ্ছে চিকুনগুনিয়াটা। প্রথম তিন দিনের মধ্যে জ্বর কমে গেলে ভালোই। তবে, তিন দিনের মধ্যে জ্বর কমে না গেলে, চিকিৎসকের কাছে যাওয়া ভালো। কারণ তখন সেটা ডেঙ্গু-চিকুনগুনিয়া হতে পারে। চিকুনগুনিয়া হলে গিরায় গিরায় ব্যথা হবে। জ্বর হলে শুধু প্যারাসিটামল খেতে হবে, পানি খেতে হবে বেশি করে। চিকুনগুনিয়ার ব্যথা কখনো গরম সেঁকে কমে, কখনো আবার বরফ দিয়ে ঠাণ্ডা সেঁকে কমে। ব্যথা নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। ব্যথাটা কমিয়ে রাখতে পারলেই ধীরে ধীরে সুস্থবোধ করতে থাকে রোগী। কারো কারো অল্প সময়ের মধ্যে চিকুনগুনিয়ার ব্যথা ভালো হয়ে যায়, কারো কারো ক্ষেত্রে অনেক সময় লাগে।
চিকিৎসা: চিকুনগুনিয়া ভাইরাসের নির্দিষ্ট কোনো চিকিৎসা নেই। ওষুধ সাধারণত লক্ষণগুলো উপশম করার জন্য ব্যবহার করা হয়। জ্বর কমানোর ওষুধ, ব্যথা উপশম করার ওষুধ, প্রচুর তরল পান করা এবং পরিমিত বিশ্রাম নিলে ৫ থেকে ১০ দিনে আক্রান্ত ব্যক্তি সাধারণত সুস্থ হয়ে যায়। তবে তীব্র রোগলক্ষণ ও গুরুতর কোনো সমস্যা হলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
প্রতিরোধে করণীয়: চিকুনগুনিয়া ভাইরাস প্রতিরোধে ভালো উপায়—মশার কামড় এড়ানো। মশারি লাগিয়ে শুতে হবে। লম্বা হাতার জামা ও ফুলপ্যান্ট পরতে হবে, প্রয়োজনে কাজের জায়গায় মশারি ব্যবহার করে, মশারোধী স্প্রে ও লোশন ব্যবহার করে মশার কামড় এড়াতে হবে। বাড়ির চারপাশে পানি জমতে না দেওয়া এবং মশা যেন ডিম পাড়তে না পারে, সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে।
ব্যথা উপশমে যা করণীয়: পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিতে হবে। গিঁটের ব্যথা থাকলে বেশি পরিশ্রম করলে তা আরও বেড়ে যেতে পারে। পর্যাপ্ত পানি, স্যুপ, ডাবের পানি ইত্যাদি পান করতে হবে। শরীর হাইড্রেটেড রাখা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আক্রান্ত গিঁটে গরম পানির ব্যাগ দিয়ে সেঁক দিলে আরাম পাওয়া যায়। রোগপ্রতিরোধ-ক্ষমতা বাড়াতে প্রোটিন, ভিটামিন-সি, ভিটামিন-ডি, ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড যুক্ত খাবার খাওয়া ভালো। রোগমুক্তির পর দীর্ঘস্থায়ী ব্যথা থাকলে, ধীরে ধীরে হালকা স্ট্রেচিং বা ফিজিওথেরাপির পরামর্শ নিতে পারেন।