
মালয়েশিয়ায় জনশক্তি রপ্তানিতে জড়িত রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর বিরুদ্ধে ঢালাও মামলা চলছে। এর ফলে সংশ্লিষ্টদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ছে। অনেকে তাদের রিক্রুটিং লাইসেন্স বিক্রি করে দিচ্ছেন। মালয়েশিয়ার নিয়োগকর্তারাও অনেকে বাংলাদেশ থেকে কর্মী নিতে চাইছেন না। সংশ্লিষ্টরা জানান, জনশক্তি রপ্তানিতে অনিয়ম হলে দোষী ব্যক্তিরা সাজা পেতেই পারেন। কিন্তু কিছু বিষয়কে সামনে এনে ঢালাও মামলা করলে এ খাতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। যদিও এর মধ্যে জনশক্তি রপ্তানি কমতে শুরু করেছে। গত ১০ মাসে বাংলাদেশ থেকে মাত্র ৫০০ জন কর্মী মালয়েশিয়ায় গিয়েছেন।
মন্ত্রণালয় ও বেসরকারি খাতের প্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মালয়েশিয়ায় জনশক্তি রপ্তানিতে নানা অনিয়মের অভিযোগ এনে ১০১টি রিক্রুটিং এজেন্সির বিরুদ্ধে পল্টন থানায় একটি মামলা করা হয়। জনৈক আলতাব খান মামলাটি দায়ের করেন। মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইনে দায়ের করা এ মামলার তদন্তের দায়িত্ব পায় সিআইডি। দীর্ঘ অনুসন্ধান শেষে সিআইডি গত ১৫ জুলাই মামলাটির চূড়ান্ত রিপোর্ট জমা দেয়। সিআইডি তাদের রিপোর্টে ঐ এজেন্সিগুলোর বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের সত্যতা পায়নি। বরং মিথ্যা মামলা করার অপরাধে বাদীর বিরুদ্ধে মামলা করার সুপারিশও করে সিআইডি।
পল্টন থানার মামলার অনুসন্ধানের পর সিআইডি চূড়ান্ত রিপোর্ট দেওয়ার পর সংস্থাটির মানি লন্ডারিং উইং বেশকিছু রিক্রুটিং এজেন্সির বিরুদ্ধে ঢালাও মামলা দেওয়া শুরু করেছে। ইতিমধ্যে বনানী থানায় করা এ মামলাগুলোর তদন্ত কর্মকর্তা নিয়োগ করা হয়েছে। শুধু প্রতিষ্ঠানের মালিক নয়, কর্মচারীদের বিরুদ্ধেও এ ধরনের মামলা হচ্ছে। একটি রিক্রুটিং এজেন্সির স্বত্বাধিকারী নাম প্রকাশ না করার শর্তে ইত্তেফাককে বলেছেন, এ ধরনের মামলার কারণে নিয়োগকর্তা এবং জনশক্তি প্রেরণাকারীদের মধ্যে আস্থার সংকট দেখা দিয়েছে। অনেকে লাইসেন্স ছেড়ে দিতে চাইছেন, যার ফলে মালয়েশিয়ায় জনশক্তি রপ্তানি দিন দিন কমছে।
এদিকে, অনেকে যেমন ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে লাইসেন্স ছেড়ে দিতে চাইছেন, আবার উলটো ঘটনাও ঘটছে। বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান তাদের লাইসেন্স নবায়নের জন্য আবেদন করলেও লাইসেন্সগুলো অদৃশ্য কারণে নবায়ন করা হচ্ছে না। প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান সচিবের কাছে লেখা এক চিঠিতে জনশক্তি রপ্তানিকারকদের সংগঠন বায়রার সদস্যরা এর প্রতিকার চেয়েছেন। চিঠিতে তারা বলেছেন, ‘সম্প্রতি মন্ত্রণালয়ের জারিকৃত নির্দেশনায় রিক্রুটিং লাইসেন্সের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের হলে নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত লাইসেন্সের সার্ভার লক এবং নবায়ন স্থগিতের বিধান রাখা হয়েছে। এর ফলে অভিযুক্ত লাইসেন্সের পাইপলাইনে থাকা সব কর্মীর ভিসা বন্ধ থাকার কারণে লাইসেন্স মালিকরাসহ অভিবাসনপ্রত্যাশীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। এর ফলে রাষ্ট্রও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বায়রার সদস্যরা চিঠিতে লাইসেন্স নবায়নসহ সার্ভার চালুর আবেদন জানান।
এদিকে, যেসব কর্মী অর্থ প্রদানের পরও মালয়েশিয়ায় যেতে পারেননি, তাদের সব দায়দেনা পরিশোধের নির্দেশনা দিয়েছিল সরকার। ২০২৪ সালের আগস্ট মাসে মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল এ নির্দেশনা দেন। পাশাপাশি যেসব কর্মী মালয়েশিয়ায় যেতে পারেননি, তাদের পাওনা পরিশোধ করে তা মন্ত্রণালয়কে অভিহিত করার কথার সিদ্ধান্তও হয়। সংশ্লিষ্টরা জানান, মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ইতিমধ্যে ঐ অর্থ পরিশোধ করা হয়েছে। এর পরও সংশ্লিষ্ট রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোকে নানাভাবে হয়রানি করা হচ্ছে।
এদিকে, নানা ধরনের টানাপড়েনে বাংলাদেশ থেকে মালয়েশিয়ায় জনশক্তি রপ্তানি উল্লেখযোগ্য হারে কমছে। সরকারি হিসাবে দেখা যায়—গত ১০ মাসে বাংলাদেশ থেকে মাত্র ৫০০ জন কর্মী মালয়েশিয়ায় গিয়েছেন। গত নভেম্বর দুই দেশের সরকারের মধ্যে যে চুক্তি হয়েছিল, তাতে বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর ৫০ হাজার কর্মী মালয়েশিয়া যাওয়ার কথা। অথচ এর আগে পাঁচ বছরে বাংলাদেশ থেকে ৫ লাখ কর্মী মালয়েশিয়া গিয়েছিলেন। অবশ্য সরকারিভাবে মালয়েশিয়া যাওয়ার জন্য সারা দেশে এরই মধ্যে ১৪ লাখ কর্মী তাদের রেজিস্ট্রেশন সম্পন্ন করেছেন। জনশক্তি রপ্তানির সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকার রিত্রুদ্ধটিং এজেন্সিগুলোকে আস্থায় আনতে না পারলে মালয়েশিয়ায় জনশক্তি রপ্তানিতে ইতিবাচক ধারা ফিরবে না।