
বিসিবিতে বর্তমান পরিচালনা পর্ষদের মেয়াদের শেষ দিনের দুপুর ছিল শান্ত, কিন্তু পরিবেশে ভর করেছিল গভীর আবহ। আজ নির্বাচন। এই লড়াইয়ের আগে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের সভাপতির দায়িত্বে থাকা সাবেক অধিনায়ক আমিনুল ইসলাম বুলবুল গতকাল মুখোমুখি হয়েছিলেন সাংবাদিকদের। তার সঙ্গে ছিলেন পরিচালনা পর্ষদের সিনিয়র সহ-সভাপতি নাজমুল আবেদীন ফাহিম। দুজনই নিজেদের কাজ, সাফল্য, সীমাবদ্ধতা ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে খোলামেলা কথা বলেছেন।
এবারের নির্বাচন মিরে নাটক মঞ্চস্থের অভিযোগ নিয়ে তারা স্পষ্ট কোনো মন্তব্য না করলেও, পুরোপুরি এড়িয়ে যেতেও পারেননি। বুলবুলকে নিয়ে ওঠা অভিযোগের জবাবও মিলেছে তার কাছ থেকে। তিনি বলেছেন, নির্বাচিত হন বা না হন-যারা নির্বাচিত হবেন, তারা ক্রিকেটের জন্যই কাজ করবেন।
গতকাল বিসিবির প্রাঙ্গণ জুড়ে ছিল নির্বাচনী আমেজ। রাস্তা থেকে প্রধান ফটক, মূল ভবন-সব জায়গা জুড়ে ঝুলছিল পরিচালক প্রার্থীদের ব্যানার-ফেস্টুন ও প্রচারণার পোস্টার। তবে একই সময়ে নির্বাচনের স্থগিতের দাবিও উঠেছে। ঢাকার বিভিন্ন ক্লাবের পক্ষ থেকে রফিকুল ইসলাম বাবু প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনুসের কাছে স্মারকলিপি জমা দিয়েছেন। দীর্ঘদিনের সংগঠক বাবুর স্বাক্ষর করা চিঠিতে দাবি করা হয়েছে-বিসিবির বর্তমান নির্বাহী পর্ষদের মেয়াদ বাড়িয়ে নির্বাচনের পুনঃতফসিল ঘোষণা, কাউন্সিলরশিপ বিতর্ক এড়াতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ, বিকল্প হিসেবে অ্যাডহক কমিটির কাছে দায়িত্ব হস্তান্তর এবং পুনর্নির্ধারিত সময়ে নতুন নির্বাচন কমিশনের অধীনে ভোটগ্রহণের ব্যবস্থা করা। ঐ চিঠিতে আরও অভিযোগ তোলা হয়েছে যে, নির্বাচনের আগেই নির্বাচন সম্পন্ন হয়ে যাচ্ছে।
এ দিকে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) নির্বাচন বর্জনের তালিকায় যুক্ত হয়েছে আরো একটি নাম। গতকাল নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দেন জামালপুর জেলা ক্রীড়া সংস্থার কাউন্সিলর হিসেবে ঢাকা বিভাগের পরিচালক পদপ্রার্থী এস এম আবদুল্লাহ আল ফুয়াদ রেদুয়ান। ১ অক্টোবর মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের দিন থাকলেও এর পর চার জন প্রার্থী নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দেন। রেদুয়ানের আগে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন ক্যাটাগরি-২-এর লিজেন্ডস অব রূপগঞ্জের কাউন্সিলর লুতফর রহমান বাদল, কাঁঠালবাগান গ্রিনক্রিসেন্টের মেজর ইমরোজ এবং রাজশাহী বিভাগের পরিচালক প্রার্থী হাসিবুল আলম। তবে নির্ধারিত দিনে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার না করায় নির্বাচনের ব্যালট পেপারে তাদের নাম থাকবে।
গতকাল বিকালে বিসিবি কার্যালয়ের সামনে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিয়ে রেদুয়ান বলেছেন, ‘আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ের রাতের ভোটকেও হার মানিয়েছে এবারের বিসিবি নির্বাচন। তার ভাষায়, ‘রাতের ভোটে তবু তো ওরা ব্যালট বাক্স ভরেছে, সেটা আলাদা জিনিস। এরা (বিসিবির নির্বাচনে) তো সুকৌশলে এমন কাজ করছে, সেটা ব্যালট বাক্সকেও হার মানিয়ে ফেলছে।’
ঢাকা বিভাগ থেকে পরিচালক হওয়ার দৌড়ে রেদুয়ানের সঙ্গে ছিলেন বিসিবির বর্তমান সভাপতি আমিনুল ইসলাম বুলবুল ও ক্রিকেট পরিচালনা বিভাগের প্রধান নাজমুল আবেদীন ফাহিম। রেদুয়ান সরে দাঁড়ানোয় বুলবুল ও ফাহিম বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়ে গেলেন। এবারের নির্বাচনে ওঠা বিভিন্ন অভিযোগ নিয়ে বুলবুল বলেছেন, ‘আমার শরীরের ওপর অনেক কিছু এসেছে, কিন্তু আমি আইন মেনে, সংবিধানের মধ্যে থেকেই কাজ করেছি।’
তামিম ইকবাল ও তার পক্ষের প্রার্থীদের সরে দাঁড়ানো প্রসঙ্গে বুলবুল বলেছেন, ‘এটা তাদের ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত। আমরা কেবল প্রক্রিয়া মেনে এগোচ্ছি।’ ক্রীড়া উপদেষ্টার প্রভাব নিয়ে প্রশ্ন উঠলে বুলবুল জানান, তিনি সবসময় সহযোগিতা করেছেন, আমি কৃতজ্ঞ। তার উদ্দেশ্য ছিল একটি স্থিতিশীল ও ঐক্যবদ্ধ বোর্ড গঠন করা আমার কাছে মনে হয়নি কোনো ইনফ্লুয়েন্স আছে। বরং মনে হয়েছে, বাংলাদেশ ক্রিকেটের জন্য ধারাবাহিকতা দরকার। ক্লাবগুলোর গুরুত্ব নিয়েও বুলবুলের মত, ক্লাবগুলোর বিকল্প নেই। তাদের অবদান অনস্বীকার্য। আমরা আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করতে চাই, সংঘাত চাই না। আশা করি আলোচনার মাধ্যমেই এই সমস্যার সমাধান হবে।’
নাজমুল আবেদীন ফাহিম নিজের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে বলেছেন, শুরুটা সহজ ছিল না। সম্পর্কের দূরত্ব ছিল, ভুল বোঝাবুঝিও ছিল। কিন্তু সময়ের সঙ্গে আমরা একসাথে কাজ করতে পেরেছি।’ তিনি আশাবাদী, তাদের শুরু করা অবকাঠামোগত উন্নয়ন আগামী কয়েক মাসেই ফল দেবে। ‘আমরা বিকেন্দ্রীকরণের যে স্বপ্ন দেখেছি, সেটা বাস্তবে রূপ নিতে বেশি সময় লাগবে না,’ বলেছেন ফাহিম।
বুলবুলও জানান, ‘আমাদের চার মাস সময় ছিল। এই সময়ে দলীয় সাফল্য এসেছে, অবকাঠামোগত কাজ শুরু হয়েছে, নতুন পরিকল্পনা হাতে নিয়েছি। ‘জাতীয় দলের ধারাবাহিক সাফল্যের পাশাপাশি তিনি মেয়েদের বিশ্বকাপগামী দল ও অনূর্ধ্ব-১৯ দলের পারফরম্যান্সের কথাও উল্লেখ করেছেন। তার ভাষায়, ‘সবাই মিলে আমরা চেষ্টা করেছি-দল হিসেবে কাজ করাই আমাদের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি।
তবে সাফল্যের ভিড়ে আক্ষেপও আছে। সময়ের অভাবে কিছু অবকাঠামোগত কাজ শেষ করতে না পারার কথা জানিয়েছেন তিনি। তার লক্ষ্য ছিল ক্রিকেটকে কেন্দ্র থেকে প্রান্তে ছড়িয়ে দেওয়া। এজন্য ‘ট্রিপল সেঞ্চুরি প্রোগ্রাম’-এর মাধ্যমে আঞ্চলিক পর্যায়ে ক্রিকেট কার্যক্রম চালু করা হয়েছে। চট্টগ্রাম ও রাজশাহীতে আয়োজন করা হয়েছে বয়সভিত্তিক টুর্নামেন্ট, পাশাপাশি কোচ, আম্পায়ার ও কিউরেটরদের প্রশিক্ষণে যুক্ত করা হয়েছে আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ সাইমন টফেল ও টনি হ্যামিংদের মতো ব্যক্তিত্বকে। বুলবুলের ভাষায়, ‘বাংলাদেশের ক্রিকেটের শক্তি অপরিসীম। এই শক্তি ঢাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, জেলা ও উপজেলা পর্যায়েও ছড়িয়ে দিতে হবে।’
নির্বাচন ঘিরে বিতর্ক ও বর্জনের প্রশ্নে বুলবুল ছিলেন সংযত। ৪৮টি ক্লাবের নির্বাচন বর্জনের ঘোষণায় তার প্রতিক্রিয়া ছিল আইনি ও নীতিগত। এটা আমাদের হাতে নেই।’ তিনি বলেছেন, ‘নির্বাচন কমিশন ও আদালত এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে। আমি সংবিধানের মধ্যে থেকেই সব কাজ করেছি।’ বুলবুল সভাপতি হওয়ার পর থেকেই গণমাধ্যমকর্মীদের ফোন না ধরা ও নম্বর ব্লকের অভিযোগ রয়েছে। গণমাধ্যমের সঙ্গে সম্পর্ক প্রসঙ্গে তিনি হাসতে হাসতে বলেছেন, ‘ব্লক না, সময়ের অভাব। আইসিসি ও এসিসির কাজে আমি ২৪ ঘণ্টা ব্যস্ত থাকি। যদি দিনটা ৩০-৩২ ঘণ্টার হতো।’
তবে প্রতিশ্রুতি দেন, ‘আমরা চাইব মিডিয়া আমাদের গঠনমূলক সমালোচনা করুক, সেটাই শেখার পথ।’ নির্বাচনী অভিজ্ঞতা প্রসঙ্গে বুলবুল বলেছেন, ‘আমি প্রথম বার নির্বাচনে অংশ নিচ্ছি। ভোট চাইতে গিয়েয় বুঝেছি, ঢাকার বউরেও বিশাল এক ক্রিকেট শক্তি আছে।’ সবশেষে এবারের নির্বাচন নিয়ে বুলবুল স্পষ্ট করে বলেছেন, ‘যে আসবে, সে ক্রিকেটের জন্য কাজ করবে। একসঙ্গে। হাতে হাত রেখে।’