
কোথাও আগুন লাগলে সেই আগুন নেভানো, আটকে পড়া মানুষদের উদ্ধার ও জিনিসপত্র রক্ষায় নিজেদের জীবন বাজি রেখে কাজ করেন ফায়ার ফাইটাররা। কিন্তু কোথাও আগুন লাগার পর ফায়ার কর্মীরা যখন আগুন নেভাতে যান তখন ভেতরে কী আছে সেই তথ্য অনেক ক্ষেত্রে গোপন করা হয়। বিশেষ করে, ভেতরে কেমিক্যাল-জাতীয় দ্রব্যাদি থাকার কথা সব সময়ই অস্বীকার করে সংশ্লিষ্টরা। ফলে অধিকাংশ ক্ষেত্রে মিথ্যা বা ভুল তথ্যে আগুন নেভাতে ভেতরে গিয়ে জীবন দিতে হচ্ছে ফায়ার ফাইটারদের।
ফায়ার সার্ভিসের এক হিসেবে দেখা গেছে, ১৯৮১ সালে ফায়ার সার্ভিস প্রতিষ্ঠার পর থেকে গত ৪৪ বছরে ৪৯ জন ফায়ার ফাইটার জীবন দিয়েছেন। ২০১৫ সাল থেকে এখন পর্যন্ত অপারেশনাল কাজে নিহত ফায়ার সার্ভিস কর্মীর সংখ্যা ছিল ২৩ জন। সর্বশেষ টঙ্গীতে দুই জনের মৃত্যুতে সংখ্যাটি দাঁড়াল ২৫ জনে। এ সময়ে আহত হয়েছেন ৩৮৬ জন। একসঙ্গে সর্বোচ্চ ১৩ জন ফায়ার ফাইটারের মৃত্যু হয় ২০২২ সালে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের বিএম কনটেইনার ডিপোতে অগ্নিকাণ্ড ও বিস্ফোরণের ঘটনায় আগুন নেভাতে গিয়ে।
গত সোমবার টঙ্গীতে একটি রাসায়নিকের গুদামে লাগা আগুন নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে ফায়ার সার্ভিসের চার কর্মী দগ্ধ হন। তাদের মধ্যে দুজন মারা গেছেন। সবশেষ গতকাল বুধবার বিকালে চিকিত্সাধীন অবস্থায় অগ্নিদগ্ধ ফায়ার ফাইটার মোহাম্মদ নুরুল হুদা মারা গেছেন। তিনি টঙ্গী ফায়ার স্টেশনের ফায়ার ফাইটার হিসেবে কর্মরত ছিলেন। জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের আবাসিক সার্জন শাওন বিন রহমান বলেন, ‘ফায়ার ফাইটার নুরুল হুদার শরীরে পোড়ার মাত্রা ছিল ১০০ ভাগ। সংকটাপন্ন অবস্থায় তাকে আইসিইউতে রাখা হয়েছিল। টঙ্গীর রাসায়নিক কারখানায় আগুন নেভাতে গিয়ে দগ্ধ আরো দুই জন হাসপাতালে চিকিত্সাধীন অবস্থায় আছেন। তারা হলেন ফায়ার ফাইটার জয় হাসান ও ফায়ার অফিসার জান্নাতুল নাঈম। তাদের মধ্যে জান্নাতুল নাঈমের শরীরের ৪২ শতাংশ এবং জয়ের ৫ শতাংশ দগ্ধ হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে, টিনশেডের গুদামটি একটি পোশাক কারখানার। সোমবার বিকালে হঠাত্ সেখানে বিস্ফোরণ ঘটে। বিস্ফোরণের পর ভেতরে থাকা লোকজন দৌড়ে বের হয়ে আসেন। ফায়ার সার্ভিসের লোকজন সেখানে যাওয়ার পর জানানো হয় ভেতরে পোশাক কারখানার আফিস। ফলে ফায়ার কর্মীরা সেই ধরনের প্রস্তুতি নিয়ে আগুন নেভানোর কাজ শুরু করেন। এর মধ্যে রাসায়নিকের এক ড্রামে বিস্ফোরণ ঘটে। ঐ কারখার মধ্যে যে রাসায়নিকের ড্রাম আছে সে তথ্য ফায়ার কর্মীদের কাছে গোপন করা হয়। ফলে ফায়ার কর্মীদের সেই ধরনের কোনো প্রস্তুতি ছিল না। আর এতেই ফায়ার সার্ভিসের চার জন দগ্ধ হন।
একজন ফায়ার ফাইটার বলেন, ‘আমরা আগুনে ঝাঁপিয়ে পড়ি, জানি এটা মৃত্যুঝুঁকি। কিন্তু যখন আগুনের ধরন, বিস্ফোরক পদার্থ, গ্যাস বা কেমিক্যালের তথ্য গোপন করা হয়, তখন আমাদের কর্মীদের মৃত্যুর মিছিল বাড়ে। এছাড়া, ঘটনাস্থলে পৌঁছানোর পর উত্তেজিত জনতা দ্রুত আগুন নেভানোর জন্য ফায়ার সার্ভিসের ওপর চড়াও হয়। এজন্য বাধ্য হয়ে আগুনের স্থানে ঝুঁকি নিয়ে প্রবেশ করলে সেখানে বিস্ফোরণ ঘটলে ফায়ার ফাইটারদের মৃত্যু হয়। কিন্তু আগে থেকে স্থানীয়রা জানেন না সেখানে কোন ধরনের মালামাল ছিল।’
ফায়ার সার্ভিসের মিডিয়া সেলের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শাহজাহান শিকদার বলেন, ‘যে কোনো কেমিক্যালের আগুন নিয়ন্ত্রণের জন্য ফায়ার সার্ভিসের পর্যাপ্ত সরঞ্জাম রয়েছে। কিন্তু আগুন লাগার পর ঘটনাস্থলের তথ্যগত সহযোগিতা ফায়ার সার্ভিসকে করা হয় না। টঙ্গীর গুদামে যে কেমিক্যাল ছিল সে তথ্য আমাদের জানানো হয়নি।’
মৃত্যু ও আহত :ফায়ার সার্ভিস সদর দপ্তর সূত্র জানায়, গত ১১ বছরে অর্থাত্ ২০১৫ থেকে ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আগুন নেভানোর সময় ফায়ার সার্ভিসের ২৫ জন কর্মী নিহত হয়েছেন। তাদের মধ্যে ১৪ জনের মৃত্যু হয় অগ্নিকাণ্ড স্থলের বিস্ফোরণ থেকে। এ সময়ে বিস্ফোরণে আহত হন ৩৮৬ কর্মী। বিস্ফোরণে নিহতরা হলেন মিঠু দেওয়ান, এমরান হোসেন, রানা মিয়া, আলাউদ্দিন, মনিরুজ্জামান, শফিউল ইসলাম, শাকিল তরফদার, গাউসুল আজম, নিপন চাকমা, রমজানুল ইসলাম, সালাউদ্দিন চৌধুরী, রবিউল ইসলাম, ফরিদুজ্জামান, শামীম আহমেদ ও নুরুল হুদা। ১৯৮১ সালে ফায়ার সার্ভিসের প্রতিষ্ঠার পর থেকে মৃত্যুর সংখ্যা ৪৯ জন।
সবচেয়ে বেশি প্রাণহানি হয় ২০২২ সালের ৫ জুন। এদিন চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে বিএম কনটেইনার ডিপোতে ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। ডিপোতে ‘হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড’ নামের বিপুল পরিমাণ রাসায়নিক ছিল। ঐ বিস্ফোরণের আগুন নেভাতে গিয়ে আগুনের তাপ ও দম বন্ধ হয়ে ফায়ার সার্ভিসের ১৩ কর্মী নিহত হন।
নেই আধুনিক সরঞ্জাম :ফায়ার সার্ভিসে এই মুহূর্তে কাজ করছেন ১৪ হাজার ৫৭০ জন। আর সারা দেশে ফায়ার সার্ভিসের স্টেশন রয়েছে ৫৩৭টি। ঝুঁকিপূর্ণ আগুন বিশেষ করে কেমিক্যাল গুদামের আগুন নেভাতে এসব স্টেশনে প্রয়োজনীয় প্রযুক্তিগত সরঞ্জাম নেই। কেমিক্যালের মতো ঝুঁকিপূর্ণ আগুন নেভাতে বেশি প্রয়োজন অটোমেটিক ফায়ার ফাইটিং রোবট। কিন্তু দেশে বিগত সময়ে মাত্র দুটি রোবট ছিল। দুই মাস আগে আরো পাঁচটি কেনা হয়েছে। তবে এগুলো প্রয়োজনের তুলনায় নগণ্য। ফায়ার ফাইটার কর্মীরা বলছেন, উন্নত বিশ্বে অগ্নিকাণ্ডের স্থলে গিয়ে প্রথমেই গ্যাস ডিটেক্টর, কেমিক্যাল ডিটেক্টর ব্যবহার করে নিশ্চিত হয় আগুনটি কোন ধরনের। কিন্তু আমাদের দেশে মাত্র ১৫ থেকে ২০টি স্টেশনে এসব ডিটেক্টর রয়েছে।
কর্মকর্তারা বলেন, ‘কেমিক্যালের আগুনের ক্ষেত্রে সংকট হলো, কেমিক্যাল যেভাবে স্টোর করা দরকার সেভাবে করা হয় না। ফলে সহজেই দুর্ঘটনা ঘটে। অধিকাংশ মানুষ সেটা জানে না। এছাড়া, ফায়ার ফাইটারদের পিপি নিয়েও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন অনেক কর্মী।’ তারা বলেন, ‘কর্মীদের ব্যবহূত একটি পিপি ৩০০ থেকে সাড়ে ৩০০ ডিগ্রি তাপমাত্রা সহ্য করার ক্ষমতা থাকার কথা। কিন্তু গাজীপুরের অগ্নিকাণ্ডে সেই পিপি ১০০ ভাগ পুড়ে গেছে। এর অর্থ পিপিতে ভেজাল আছে। সঠিক মানের পিপি কেনা হয়নি। ফায়ার সার্ভিসের মিডিয়া সেলের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শাহজাহান শিকদার বলেন, ‘কেমিক্যালের মতো বিশেষ ধরনের আগুন আগে কম ছিল। তবে এখন বাড়ছে। তাই ইকুইপমেন্ট (যন্ত্রপাতি) বাড়ানোর চেষ্টা করা হচ্ছে।’
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘রাসায়নিক গুদাম বা শিল্প এলাকায় অগ্নিকাণ্ডের ক্ষেত্রে পরিস্থিতি ভয়াবহ হয়। উন্নত প্রটেক্টিভ গিয়ার, শ্বাসনালি সুরক্ষা, পর্যাপ্ত অক্সিজেন সিলিন্ডার ও উপযুক্ত প্রশিক্ষণ থাকলে প্রাণহানি কমানো সম্ভব।’
ফায়ার সার্ভিসের সাবেক মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ইঞ্জিনিয়ার আলী আহম্মেদ খান বলেন, ‘রাসায়নিক অগ্নিকাণ্ডে কাজ করার জন্য আমাদের আরো উন্নতমানের সরঞ্জাম দরকার। অনেক সময় পোশাক ও অক্সিজেন সিলিন্ডারের মান যথেষ্ট না হওয়ায় দগ্ধ বা বিষক্রিয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়। এতে ফায়ার কর্মীদের মৃত্যু হচ্ছে।
আর্থিক নিশ্চয়তা প্রয়োজন :ফায়ার কর্মীদের একজনের মৃত্যুতে একটি পরিবার নিরাপত্তাহীনতায় পড়ে। আগুন নেভাতে গিয়ে জীবন দেওয়া ফায়ার কর্মীদের পরিবারের জন্য নেই কোনো বিশেষ সুযোগ-সুবিধা। আইন অনুযায়ী পেশনের যে সুযোগ-সুবিধা সেটা তাদের পরিবার পেয়ে থাকে। পাশাপাশি সরকার বা কোনো বেসরকারি উদ্যোগে কোনো বিশেষ অনুদান দেওয়া হলে সেটা অতিরিক্ত হিসেবে পায় পরিবার। তাও খুব বেশি না।
ফায়ার কর্মীরা বলছেন, ‘ফায়ার সার্ভিস থেকে কিছু আর্থিক সহায়তা দেওয়া হলেও তা পর্যাপ্ত নয়। সামাজিক নিরাপত্তা ও বিমা-কাঠামো শক্তিশালী করা গেলে এ ধরনের বীরদের পরিবার কিছুটা স্বস্তি পেতে পারে। বিশেষ করে, বিমা-সুবিধা ফায়ার কর্মীদের জন্য খুবই প্রয়োজন। যে উদ্যোগটা বর্তমান সরকারই নিতে পারে।’