
আত্মহত্যা একটি গুরুতর জনস্বাস্থ্য সমস্যা। মানসিক রোগ মানুষকে আত্মহত্যাপ্রবণ করে তোলে। প্রতি বছর বাংলাদেশে ১০ হাজারের বেশি মানুষ আত্মহত্যা করে। যা সড়ক দুর্ঘটনার পরে দেশের দ্বিতীয় প্রধান মৃত্যুর কারণ। বিশেষ করে কিশোর-কিশোরী ও নারীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা বিশেষজ্ঞদের মধ্যে উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে আত্মহত্যা প্রতিরোধে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা, সামাজিক সচেতনতা এবং কার্যকর নীতিমালা প্রণয়নের প্রয়োজনীয়তা অত্যন্ত জরুরি। জরিপে দেখা গেছে ১৩ থেকে ১৯ বছর বয়সীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি যা প্রায় ৬৫ দশমিক ৭ শতাংশ। এই বয়সীদের মধ্যে আত্মহত্যার অন্যতম কারণ বুলিং, চরম হতাশা, মাদকাসক্তসহ বিবিধ কারণ। তারা বলছেন, আত্মহত্যার চিন্তা একজন মানুষের মনের গভীরে অনেক সময় ধীরে ধীরে সঞ্চারিত হয়। আত্মহত্যা হলো ইচ্ছাকৃতভাবে নিজের জীবন সমাপ্ত করার একটি প্রক্রিয়া। এটি কোনো একক ঘটনা নয়। এটি অনেকগুলো সমস্যার সমন্বয়ে তৈরি একটি ব্যাধি।
পরিসংখ্যান যা বলছে : বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) তথ্য বলছে, দেশে প্রতিদিন গড়ে ৫৬ জন আত্মহত্যা করে। নারীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি। ১০ থেকে ২৯ বছর বয়সী নারীদের মধ্যে আত্মহত্যার হার দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সর্বোচ্চ বাংলাদেশে। এছাড়া, ২০২৪ সালে বেসরকারি সংস্থা আচল ফাউন্ডেশনের গবেষণায় দেখা গেছে, ২০২৩ সালে দেশে ৫১৩ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে, যার মধ্যে ৬১ শতাংশ নারী। ২০২৪ সালে বাংলাদেশে আত্মহত্যা করা শিক্ষার্থীদের মধ্যে দুঃখজনকভাবে ৪৯.৪ শতাংশ (৩১০ জন) ছিল স্কুল শিক্ষার্থী। এই পরিসংখ্যানগুলো নির্দেশ করে যে, বাংলাদেশে আত্মহত্যা প্রতিরোধে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা, সামাজিক সচেতনতা এবং কার্যকর নীতিমালা প্রণয়নের প্রয়োজনীয়তা অত্যন্ত জরুরি।
বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য বলছে, বাংলাদেশে ঠিক কত সংখ্যক মানুষ মানসিক সমস্যায় ভুগছেন এর একটি ধারণা পাওয়া যায় ২০১৯ সালের জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য জরিপে। যেখানে দেখা গেছে, দেশের অন্তত ১৯ শতাংশ মানুষ মানসিক রোগে ভুগছেন। বাংলাদেশে প্রয়োজনের তুলনায় মানসিক চিকিৎসকের সংখ্যা একেবারেই অপ্রতুল। দেশে মানসিক চিকিৎসক রয়েছেন মাত্র ২৬০ জন। অর্থাৎ প্রতি ১০ লাখ মানুষের জন্য দুই জনেরও কম চিকিৎসক। দেশে মনোবিজ্ঞানী রয়েছে ৫৬৫ জন অর্থাৎ প্রতি ১০ লাখ মানুষের জন্য চার জনেরও কম। এদের অধিকাংশই আবার শহর এলাকায় থাকেন। ফলে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীকে সরাসরি মানসিক সেবা প্রদান করা বড় চ্যালেঞ্জ। গবেষণায় আরও উঠে এসেছে দেশে সাইবার বুলিং কিশোরী ও নারীদের মানসিক স্বাস্থ্যে মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। জরিপে অংশ নেওয়া কিশোরীদের মধ্যে ৮ শতাংশ গত এক বছরে সাইবার বুলিংয়ের শিকার হয়েছে এবং সামগ্রিকভাবে ১২ শতাংশ কিশোরীর মধ্যে তীব্র বিষণ্ণতা রয়েছে।
সমস্যার সমন্বিত পরিণতি আত্মহত্যা :আত্মহত্যার পেছনে একাধিক মানসিক, সামাজিক ও ব্যক্তিগত কারণ থাকতে পারে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু কারণের মধ্যে বিষণ্ণতা, উদ্বেগজনিত সমস্যা, বাইপোলার ডিসঅর্ডার, সিজোফ্রেনিয়া, সামাজিক ও ব্যক্তিগত চাপ, পারিবারিক বা সম্পর্কজনিত সমস্যা, আর্থিক সংকট, কর্মক্ষেত্রের চাপ, একাকীত্ব এবং সামাজিক বিচ্ছিন্নতা, আঘাতমূলক অভিজ্ঞতা, শারীরিক বা মানসিক নির্যাতন, যৌন হয়রানি বা নিপীড়ন, প্রিয়জনের মৃত্যু বা বিচ্ছেদ, মাদক ও অ্যালকোহলের আসক্তি অন্যতম।
পরিকল্পনা চিহ্নিত করা : কোনো ব্যক্তি আত্মহত্যার চিন্তা করছেন কি-না, তা বোঝার জন্য কিছু সাধারণ লক্ষণ থাকে। যেমন- হঠাত্ করে চুপ হয়ে যাওয়া বা নিজেকে গুটিয়ে নেওয়া, একাকী সময় কাটানো বা কারো সঙ্গে মিশতে ভালো না লাগা, স্বাভাবিক বা সামাজিক কার্যকলাপ থেকে নিজেকে সরিয়ে নেওয়া, প্রিয়জনদের কাছ থেকে নিজেকে দূরে সরে নেওয়া, হঠাত্ অপ্রত্যাশিতভাবে শান্ত হয়ে যাওয়া। অথবা দীর্ঘমেয়াদি হতাশা, তীব্র অপরাধবোধ বা নিজেকে মূল্যহীন মনে করা, আত্মহত্যার করার কথা বলা।
আত্মহননের আগে অনেক ব্যক্তি কোনো না কোনোভাবে সংকেত দিয়ে থাকেন এবং সাহায্যের প্রত্যাশা করেন। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আত্মহত্যাপ্রবণ ব্যক্তির পাশে ঘনিষ্ঠ বন্ধু বা আত্মীয়-স্বজন থাকেন না, যারা তাদের আবেগগত সমর্থন দিতে পারেন। তাই উন্নত দেশগুলোর মতো আমাদের দেশেও আত্মহত্যা প্রতিরোধ কেন্দ্র গড়ে তোলা অত্যন্ত জরুরি। বাংলাদেশে ‘কান পেতে রই’ (একটি মানসিক সহায়তা হেল্পলাইন) এবং ‘মনের বন্ধু’ (অনলাইন মানসিক সহায়তা প্ল্যাটফরম)-এর মতো সংগঠনগুলো এই ধরনের মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তা প্রদান করছে।
মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা বিষয়ে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব কাজী দেলোয়ার হোসেন বলেন, ‘অন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের মতো আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যকেও যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। আশার কথা হলো সরকার এরই মধ্যে মেন্টাল হেলথ অ্যাক্ট, মেন্টাল হেলথ পলিসি প্রণয়ন করেছে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, আমরা এগুলোকে সবার জন্য কীভাবে স্থায়ীভাবে বাস্তবায়ন করব, তা নিয়ে ভাবতে হবে।’
মানসিক স্বাস্থ্যের গুরুত্ব সম্পর্কে অধ্যাপক ডা. সায়েবা আক্তার বলেন, মানসিক স্বাস্থ্যকে শারীরিক স্বাস্থ্যের মতো গুরুত্ব দেওয়া হয় না। নারীদের ক্ষেত্রে এ সমস্যা আরও ভয়াবহ। জাতি হিসেবে কিংবা অর্থনৈতিক দিক থেকে উন্নতি করতে হলে আমাদের সম্মিলিতভাবে মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি নজর দিতে হবে।
বিশিষ্ট মনোরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক হেলাল উদ্দিন আহমদ বলেন, ‘আত্মহত্যা প্রতিরোধ যোগ্য। আত্মহত্যার আগে ঐ ব্যক্তি নানাভাবে সংকেত দেন, সেসব বুঝতে পারলে এবং প্রয়োজন মতো ব্যবস্থা নিতে পারলে আত্মহত্যা প্রতিরোধ করা যায়। পরিবারের মানুষ এ ব্যাপারে প্রথম ভূমিকা রাখতে পারে। এছাড়া মানসিক স্বাস্থ্যের চিকিৎসার মাধ্যমেও এই আত্মহত্যা ঠেকানো সম্ভব।’