
বিস্কুটের প্যাকেটটি হাতে নিয়ে খুবই হতাশ ভঙ্গিতে চাকরিজীবী রোবায়েত হাসান বললেন, দিনদিন প্যাকেটের আকার ছোট হচ্ছে। আগের তুলনায় বিস্কুটের পরিমাণ কমে অর্ধেকে নেমে এসেছে। অথচ কিছুদিন আগেও ১৫ টাকার এই বিস্কুটের প্যাকেট দিয়ে অনায়াসে বিকালের নাস্তা করা যেত। রাজধানীর কাওরান বাজারে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডায় তার কথায় সায় দিলেও অন্যরাও। কিন্তু শুধু কি বিস্কুট, মোড়কজাত কেক, পাউরুটিসহ সব খাবারের পরিমাণই প্যাকেটে আগের তুলনায় অনেক কমেছে। হোটেল, রেস্তোরাঁতেও পরোটার আকার দিনদিন ছোট হচ্ছে। কিন্তু দামে কোনো ছাড় নেই। উলটো দাম আরও বেড়েছে। শুধু তাই নয়, পণ্য মোড়কজাত হলেই দাম অনেক বেড়ে যাচ্ছে।
রাজধানীর খোলাবাজারে খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, ভালো মানের চিনিগুঁড়া সুগন্ধী চাল বিক্রি হচ্ছে ১১০ থেকে ১২০ টাকায়। একই মানের চাল বিভিন্ন কোম্পানি মোড়কজাত করে বিক্রি করছে ১৫০ থেকে ১৫৫ টাকায়। এক কেজি চালে দামের পার্থক্য ৩৫ থেকে ৪০ টাকা। যা খুচরা বাজারের তুলনায় ৩০ শতাংশের বেশি। বিভিন্ন মশলার দামে ব্যবধানটা আরও বেশি। কোম্পানিগুলো মোড়কজাত করে ৫০০ গ্রাম জিরার গুঁড়ো বিক্রি করছে ৭৪০ থেকে ৭৫০ টাকা। অথচ খোলা বাজারে ৫০০ গ্রাম জিরার গুঁড়ো পাওয়া যাচ্ছে ৪৮০ থেকে ৫০০ টাকায়। হলুদ, মরিচসহ অন্যান্য মশলার ক্ষেত্রেও মোড়কজাত আর খোলা বাজারের দামের ব্যবধানটা এ রকমই।
তবে শুধু চিনিগুঁড়া সুগন্ধি চাল বা মশলাই নয়। মোড়কজাত আটা, ময়দা বা অন্যান্য পণ্যের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। বিভিন্ন কোম্পানির মাত্র ১৮০ গ্রাম মোড়কজাত টোস্ট বিস্কুট বিক্রি হচ্ছে ১২০ থেকে ১৩০ টাকায়। অথচ সরকারের বিপণন সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্য বলছে, বর্তমানে খোলা বাজারে প্রতি কেজি আটা, ময়দা বিক্রি হচ্ছে ৪৫ থেকে ৬৫ টাকায়। এসব কোম্পানি মোড়কজাত করে ঝালমুড়ি বিক্রি করে। ১০ টাকা দামের এ রকম একটি প্যাকেট খুলে ভেতরে এক মুঠো মুড়িও পাওয়া যায় না। অথচ খোলা বাজারে এক কেজি মুড়ি বিক্রি হচ্ছে ৭০ থেকে ৮০ টাকায়। তাহলে মোড়কজাত পণ্যের দাম এত বেশি হবে কেন?
কোম্পানিগুলো বলছে, মোড়কজাত করে যেসব পণ্য বিক্রি করা হয়, তা মানের দিক দিয়ে ভালো। এছাড়া প্রতিনিয়ত পণ্যের উৎপাদন খরচ বাড়ছে। ভোক্তাদের অভিযোগ, খোলা বাজারের তুলনায় মোড়কজাত পণ্যের দামের ব্যবধানটা অনেক বেশি। এতে তারা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। তাদের প্রশ্ন? পণ্যের দাম নির্ধারণ করে কারা? এবং সেটা কীভাবে? বিষয়টি নিয়ে বছর তিনেক আগে ভোক্তার অধিকার নিয়ে কাজ করা সরকারের সংস্থা জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর পণ্যের উৎপাদক, সরবরাহকারীদের নিয়ে বৈঠক করলেও এখন পর্যন্ত এর কোনো সুরাহা হয়নি।
বাজারে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, এখন প্রায় সকল ধরনের ভোগ্যপণ্যই মোড়কজাত করে বিক্রি করা হচ্ছে। এর মধ্যে মশলাজাতীয় পণ্য, চাল, আটা, ময়দা, চিনি, সেমাই, সুজিসহ অনেক পণ্য বেশি বিক্রি হচ্ছে। এর বাইরে বিস্কুট, চিপসের মতো অনেক শিশুখাদ্যও মোড়কজাত করে বিক্রি করা হচ্ছে। বাজারে অনুসন্ধান করে দেখা গেছে, যে কোনো পণ্য মোড়কজাত করা হলেই পণ্যের দাম বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যায়।
এ প্রসঙ্গে কনজুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহসভাপতি এফ এম নাজির হোসেইন গতকাল ইত্তেফাককে বলেন, মোড়কজাত পণ্যের আকার দিনদিন ছোট হচ্ছে। এছাড়া, পণ্য প্যাকেটে ভরেই দাম দ্বিগুণ করে ফেলা হচ্ছে। এটা ক্রেতার সঙ্গে প্রতারণা ছাড়া আর কিছুই না। তিনি বলেন, কোম্পানিগুলো মোড়কজাত পণ্যের যে দাম নির্ধারণ করছে, এটা ঠিক আছে কি না? এটা নিয়ে সরকারের কোনো বিশ্লেষণ নেই। তিনি বলেন, কোম্পানিগুলো বলছে, মোড়কজাত করে তারা পণ্যের ভ্যালু অ্যাড করছে। কিন্তু কতটুকু ভ্যালু অ্যাড করছে? যদি ১০ টাকার ভ্যালু অ্যাড করে কোম্পানিগুলো ৩০ টাকা নেয়, তাহলেতো হবে না। প্রাণ-আরএফএলের পরিচালক (বিপণন) কামরুজ্জামান কামাল এ প্রসঙ্গে ইত্তেফাককে বলেন, উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান পণ্যের দাম নির্ধারণ করলেও এর সঙ্গে অনেক বিষয় জড়িত থাকে। কোনো কোম্পানি ইচ্ছা করলেই অনেক বেশি মুনাফা করার সুযোগ নেই। কারণ, বাজারে অনেক কোম্পানির একই প্রোডাক্ট রয়েছে। প্রতিযোগিতা করে তাকে টিকে থাকতে হচ্ছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বাছাই করে ভালো পণ্য মোড়কজাত করা হয়। এটা স্বাস্থ্যের জন্যও ভালো। এজন্য মোড়কজাত পণ্যের দাম একটু বেশি হবে। একই কথা জানিয়েছেন মেঘনা গ্রুপের ডিজিএম তসলিম শাহরিয়ার। তিনি ইত্তেফাককে বলেন, উৎপাদকরাই পণ্যের মূল্য নির্ধারণ করে। তবে সয়াবিন ও পামঅয়েলের মতো অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের ক্ষেত্রে আমরা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বসে দাম নির্ধারণ করি। এছাড়া, আটা, ময়দাসহ অন্যান্য মোড়কজাত পণ্যের দাম উৎপাদনকারীরাই নির্ধারণ করে। খোলাবাজারের তুলনায় মোড়কজাত পণ্যের দাম অনেক বেশি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, মোড়কজাত পণ্যের মান ভালো। এছাড়া, পণ্য মোড়কজাত করা, বিপণনসহ আরও বিভিন্ন খরচ এর সঙ্গে যুক্ত হয়। প্রতিযোগিতামূলক বাজারে পণ্যের দাম বেশি রাখার সুযোগ নেই বলে তিনি জানান।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশে অত্যাবশ্যকীয় পণ্য নিয়ন্ত্রণ আইন, ১৯৫৬ বা এসেনশিয়াল কমোডিটি অ্যাক্ট, ১৯৫৭-এর আওতায় শুধু অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের ক্ষেত্রে সরকারের দাম নির্ধারণ করে দেওয়ার সুযোগ রয়েছে। বর্তমানে এই আইনের আওতায় ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠক করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সয়াবিন, পামঅয়েল ও চিনির দর নির্ধারণ করে থাকে। ২০১২ সালে এই আইন অনুযায়ী প্রজ্ঞাপন জারির মাধ্যমে ১৭টি পণ্যকে অত্যাবশ্যকীয় হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছিল। এ পণ্যগুলো হলো :পেঁয়াজ, রসুন, মসুর ডাল, ছোলা, শুকনা মরিচ, দারুচিনি, লবঙ্গ, এলাচ, ধনে, জিরা, আদা, হলুদ, তেজপাতা, সয়াবিন তেল, পামতেল, চিনি ও বিট লবণ ছাড়া অন্যান্য খাবার লবণ। গত বছরের শুরুতে তৎকালীন সরকার দ্রব্যমূল্য ও বাজার নিয়ন্ত্রণে অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের তালিকা হালনাগাদ করার পাশাপাশি চিহ্নিত অপরাধের শাস্তি বাড়িয়ে নতুন আইন করার উদ্যোগ নেয়। ঐ বছরের ৭ মে ‘অত্যাবশ্যকীয় পণ্য আইন-২০২৪’ এর খসড়া বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছে। নতুন আইনের খসড়ায় অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের তালিকায় খাদ্যশস্যের মধ্যে ধান, চাল ও গম, আটা, আলু, বীজ ও চারা, মসুর ডাল, ছোলা, ভোজ্য তেল ও তৈলবীজ, পেঁয়াজ, রসুন, শুকনা মরিচ, দারুচিনি, লবঙ্গ, এলাচ, ধনে, জিরা, আদা, হলুদ, চিনি, খাবার লবণ (বিট লবণ ছাড়া), গুড়, মাছ, মত্স্যজাত খাদ্য, মাংস, দুধ, ডিমের এর নাম রয়েছে। এছাড়া, শিশু ও রোগীর খাবার এবং অনুরূপ দ্রব্যাদি, ওষুধ এবং ইনজেকশনের মাধ্যমে যা গ্রহণ করা হয়, চিকিৎসা ও শৈল্য চিকিৎসার যন্ত্রপাতি এবং চিকিৎসা সংশ্লিষ্ট যন্ত্রপাতি, কাগজ, নিউজপ্রিন্ট, সার, জ্বালানি তেল (পেট্রোল, ডিজেল, কেরোসিন, ফার্নেস অয়েল), গ্যাস (পাইপলাইনে সরবরাহ করা গ্যাস ও এলপিজি) ও রাসায়নিক দ্রব্যাদি, বিদ্যুৎ (সৌর বিদ্যুত্সহ), লোহা ও ইস্পাত, সিমেন্ট রাখা হয়েছে।
২০১২ সালের প্রজ্ঞাপন ও পুরোনো আইনের ক্ষমতাবলে খাদ্যপণ্যের মধ্যে কেবল সয়াবিন তেল ও চিনির মূল্য নিয়ন্ত্রণ করে আসছিল বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এ বিষয়ে নতুন আইন কার্যকর হলে ধান, চাল, পেঁয়াজ, রসুনসহ অন্যান্য মশলাসহ আরও অনেক পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে সরকার। নতুন আইনের খসড়ায় অপরাধ প্রমাণিত হলে তিন বছরের কারাদণ্ড, সর্বোচ্চ ১০ লাখ টাকা জরিমানা প্রস্তাব করা হয়েছে। এমনকি উভয় দণ্ডও হতে পারে। সংশ্লিষ্ট সূত্র বলেছে, বিভিন্ন মোড়কজাত খাদ্যপণ্যের পাশাপাশি একটি বাল্বের দাম কত হবে, একটি সাবানের দাম কত হওয়া উচিত? এসব দেখার কোনো আইনি কাঠামো দেশে নেই।
এ প্রসঙ্গে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের পরিচালক (কার্যক্রম ও গবেষণা) ফকির মুহাম্মদ মুনাওয়ার হোসেন গতকাল ইত্তেফাককে বলেন, বর্তমানে মোড়কজাত বিভিন্ন পণ্যের দাম উৎপাদক প্রতিষ্ঠান নির্ধারণ করে। শুধু অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের ক্ষেত্রে সরকারের দাম নির্ধারণের সুযোগ আছে। তিনি বলেন, ভোক্তা অধিকার আইনেও আমরা পণ্যের দাম নিয়ে কথা বলতে পারি না। যদি না মনে হয়, পণ্যটি বাজারের চেয়ে বেশি দরে বিক্রি হচ্ছে এবং এটা সিন্ডিকেট করে করা হচ্ছে।