
হাসপাতালের মর্গে থাকা লাশের পরিচয় নিশ্চিত না হলে ‘বেওয়ারিশ’ হিসেবে ঠাঁই হচ্ছে কবরে। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বেওয়ারিশ লাশের সংখ্যা দিনদিন বেড়েই চলেছে। বিভিন্ন নদী-খাল থেকে উদ্ধারকৃত লাশ, সড়ক দুর্ঘটনা, ট্রেনে কাটা কিংবা অজ্ঞাত কারণে মৃত্যুর পর এসব লাশের পরিচয় মিলছে না। চলতি বছরের অক্টোবরে এ সংখ্যা ছিল ৬৬। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৯ মাসে দাফন করা হয়েছে ৪৬৮ জনের লাশ। অর্থাৎ ১০ মাসে ৫৩৪টি লাশ বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করেছে আঞ্জুমানে মুফিদুল ইসলাম।
তাদের তথ্য অনুযায়ী, গত বছরে সংস্থাটি মোট ৫৭০টি বেওয়ারিশ লাশ দাফন করেছে। তার আগের বছর এই সংখ্যা ছিল প্রায় ৪০০-এর মতো। সংস্থাটির একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘প্রতিদিনই অন্তত এক-দুইটি লাশ আমাদের কাছে আসে। অনেক সময় নদী বা ড্রেন থেকে পচা লাশ উদ্ধার হয়, আবার কখনো দুর্ঘটনায় বিকৃত দেহের পরিচয় মেলানো যায় না। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কেউ এসে দাবি করেন না।’
পুলিশ সদর দপ্তরের পরিসংখ্যান বলছে, প্রতি মাসে থানাগুলোতে প্রায় আড়াই হাজার অপমৃত্যুর মামলা নথিভুক্ত হয়। সবচেয়ে বেশি লাশ মেলে নারায়ণগঞ্জ অঞ্চলে। গত বছর নদী থেকে ৪৪০ মরদেহ উদ্ধার হলেও ১৪১ জনের পরিচয় এখনো শনাক্ত হয়নি। এ বছর উদ্ধার করা মরদেহগুলোর মধ্যে ৪১টির ক্ষেত্রে হত্যা মামলা হয়েছে।
নদীতে লাশ ফেলে হত্যার প্রমাণ লুকানো হয়
নদীতে লাশ ফেলে হত্যার আলামত নষ্ট করা হচ্ছে। পানিতে দেহ পচে যায়, সেগুলো মাছ ও পোকায় খায়, এতে নষ্ট হয় প্রমাণ। চলতি বছর নদীতে লাশের মিছিল বড় হয়েছে গত বছরের চেয়ে। শুধু নদীতে নয়, ডাঙ্গায়ও মিলছে লাশ। রাজধানীসহ সারা দেশের থানাগুলোতে দৈনিক গড়ে ৮৩টি অপমৃত্যুর মামলা রেকর্ড হচ্ছে। অর্থাৎ, ৮৩টি মৃত্যু হচ্ছে প্রতিদিন। এসব অপমৃত্যুর মধ্যে প্রতিদিন গড়ে দুই থেকে তিনটি লাশ বেওয়ারিশ থাকছে।
গত ২৩ আগস্ট বুড়িগঙ্গা নদী থেকে উদ্ধার করা হয় এক নারী ও এক শিশুর নিথর দেহ। ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন বলছে, তাদের জীবনের বাতি নিভিয়ে দেওয়া হয়েছিল শ্বাসরোধ করে। এ ঘটনায় সদরঘাট নৌ-থানায় দায়ের হয়েছে একটি হত্যা মামলা। কিন্তু দুই মাস কেটে গেলেও তাদের পরিচয় মেলেনি। আঙুলের ছাপ মুছে গেছে পানিতে, তাই পরিচয় শনাক্ত করা যায়নি। পুলিশ বলছে, মরদেহ দুটির ডিএনএ সংরক্ষণ করা হয়েছে।
নৌ-পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য অনুসারে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত দেশ জুড়ে অন্তত ৩০১ নারী-পুরুষ ও শিশুর মরদেহ উদ্ধার হয়েছে। এদের মধ্যে ২০৯ জনের পরিচয় জানা গেছে, বাকি ৯২ জন এখনো ‘অজ্ঞাতপরিচয়’। গত বছর নদী থেকে অন্তত ৪৪০টি মরদেহ উদ্ধার হয়েছিল, যার মধ্যে ১৪১ জনের পরিচয় এখনো শনাক্ত হয়নি। মরদেহ উদ্ধারের পর এ বছর বিভিন্ন থানায় অন্তত ৪১টি হত্যা মামলা হয়েছে। গত বছর মামলা হয়েছিল ৫৩টি।
নৌ-পুলিশ প্রধান অতিরিক্ত আইজিপি কুসুম দেওয়ান বলেন, ‘নদী থেকে মরদেহ উদ্ধার হলে পরিচয় শনাক্ত করাই তদন্ত এগিয়ে নেওয়া ও ন্যায়বিচার নিশ্চিতের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়।’
মানবাধিকার সংগঠন মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন (এমএসএফ) বলেছে, ‘অজ্ঞাতনামা লাশ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলেছে। অজ্ঞাতনামা লাশ উদ্ধার হয়েছে জানিয়েই দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। পরিচয় উদ্ধার করে হত্যার সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের কর্তব্য।’
ট্রেনে কাটা পড়ে হচ্ছে বেওয়ারিশ
রাজধানীর কমলাপুর, তেজগাঁও, বনানী ও বিমানবন্দর রেল স্টেশনের আশপাশে প্রায়ই ট্রেনে কাটা পড়ে অজ্ঞাত ব্যক্তির মৃত্যু হয়। স্থানীয় থানাগুলো লাশের ছবি ও তথ্য সংরক্ষণ করলেও পরিচয় শনাক্ত না হলে তিনদিন পর ময়নাতদন্ত শেষে লাশগুলো আঞ্জুমানে মুফিদুল ইসলামের কাছে হস্তান্তর করা হয়।
রেলওয়ে পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত চার বছরে ঢাকা জেলায় ট্রেনে কাটা পড়ে মারা গেছেন ১ হাজার ৭৬৩ জন। এ সময়ে সারা দেশে ট্রেনে কাটা পড়ে মারা গেছেন ৩ হাজার ৯১৮ জন, অর্থাৎ ঢাকা জেলায় মারা যায় এক-তৃতীয়াংশ মানুষ। রেলওয়ের ঢাকা জেলার মধ্যে পড়েছে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, গাজীপুর, টাঙ্গাইল, নরসিংদী ও কিশোরগঞ্জ।
রেলওয়ে পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, গত ১০ বছরে অসতর্কতা ও অসচেতনভাবে রেললাইন ব্যবহারের কারণে ৯ হাজার ২৩৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে গত তিন বছরে মৃত্যু বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ১৪০ জনে, অর্থাৎ এ সময়ে প্রতিদিন গড়ে ট্রেনে কাটা পড়ে তিন জনের মৃত্যু হয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ড. তৌহিদুল হক বলেন, ‘অজ্ঞাতনামা লাশের সংখ্যা বৃদ্ধি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকা নিয়ে সন্দেহ সৃষ্টি করে। এটা মানবাধিকার পরিস্থিতির চরম অবনতির চিত্রও তুলে ধরে। পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এই লাশ উদ্ধার করেই ক্ষান্ত হচ্ছে। এসব লাশ উদ্ধার করে তার পরিচয় শনাক্ত করা, সুরতহাল ও ময়নাতদন্ত করে মৃত্যুর কারণ উদঘাটন করাই শুধু নয়, এসব লাশ আত্মীয়-পরিজনের কাছে পৌঁছে দেওয়া এসব বাহিনীর কাজ।’