
ক্রিকেটের মাঠে যখন লাল-সবুজের জার্সি গায়ে খেলোয়াড়রা লড়াই করেন, তখন গোটা জাতি আবেগে ভাসে। ব্যর্থতার দীর্ঘ ইতিহাস সত্ত্বেও ক্রিকেটই এই দেশের সবচেয়ে বড় বিনোদন। অথচ, ক্রিকেটের ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার কথা যাদের, সেই বিসিবির চিত্র যেন এক হতাশার ক্যানভাস। সংস্থাটির নির্বাচন ঘিরে ভোটার তালিকা, কাউন্সিলরশিপ, নির্বাচন কমিশন-সব কিছুতেই অস্বচ্ছতা, অভিযোগ আর বিভ্রান্তির ছায়া। যেন ২২ গজের লড়াই হারিয়ে গেছে, জায়গা করে নিয়েছে ক্ষমতার দাপট আর ব্যক্তিগত স্বার্থের দৌড়ঝাঁপ।
নির্বাচন কমিশন গঠনের পর থেকেই হাওয়া বদলের মতো শুরু হয়েছে বিতর্ক। সভাপতি আমিনুল ইসলাম বুলবুলের চিঠি নিয়ে উঠল প্রশ্ন, সাবেক অধিনায়ক তামিম ইকবাল থেকে শুরু করে অনেক সংগঠক সংবাদ সম্মেলন করলেন সরকারের হস্তক্ষেপের অভিযোগে। ক্রিকেট বোর্ড ঘেরাওয়ের হুমকি, পালটা অভিযোগে ‘সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের’ তকমা-সব মিলিয়ে নির্বাচনের আবহটা হয়ে উঠেছে যেন কোনো নাটকীয় রাজনৈতিক লড়াই।
সবচেয়ে বড় ধাক্কা এসেছে কাউন্সিলর তালিকা প্রকাশের পর। যাদের রক্ত-ঘামে ক্রিকেট দাঁড়িয়েছে, সেই দীর্ঘদিনের সংগঠকদের নাম বাদ পড়েছে। আকরাম খান, মাহবুব আনাম নিজেরাই নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ালেও, মিডিয়া বিভাগের চেয়ারম্যান ইফতেখার রহমান মিঠুর নাম বাদ পড়ায় হতাশার ঢেউ বইছে। তিনি নিজেই ক্ষোভ উগরে দৈনিক ইত্তেফাককে গতকাল বলেছেন, ‘একজন মিঠু না থাকলে কিছু যায় আসে না, কিন্তু প্রক্রিয়া তো থাকতে হবে।’ তার কণ্ঠে লুকানো আক্ষেপটা যেন হাজারো ক্রিকেটপ্রেমীর হতাশার প্রতিচ্ছবি।
অন্যদিকে, যাদের নাম থাকার কথা নয়, তাদেরকেই দেখা যাচ্ছে তালিকায়। ইউটিউবার, হোটেল সিইও কিংবা বোর্ড সভাপতির উপদেষ্টারা পাচ্ছেন ভোটাধিকার, অথচ প্রকৃত সংগঠকরা বঞ্চিত। আরও অবাক করা ব্যাপার- নির্বাচন কমিশনের একজন সদস্যই আবার ভোটার তালিকায়। নৈতিকতাবিরোধীর পাশাপাশি অনেকে চোখে এটি প্রহসন বলে অভিযোগ করেছেন।
ভোটার তালিকার অনিয়ম নিয়েও শুরু হয়েছে বিতর্ক। ২ নম্বর ক্যাটাগরিতে ৭৬ জন থাকার কথা থাকলেও দেখা যাচ্ছে মাত্র ৬১ জন। দুদকের তদন্তে থাকা ১৫টি ক্লাবকে হঠাৎ বাদ দেওয়া হয়েছে জাতীয় স্বার্থের নামে। বিসিবিতে চাকরি করেন এমন অনেকে ভোটার হয়েছেন। আব্দুর রাজ্জাক, হাবিবুল বাশার সুমন, গাজী আশরাফ হোসেন লিপু, মোহাম্মদ আশরাফুল, হাসিবুল হোসেন শান্ত, মিনহাজুল আবেদীন নান্নু, মোহাম্মদ আলী খান সবাই বোর্ডের বেতনভুক্ত। তাদের ভোটার তথা কাউন্সিলর হিসেবে মনোনয়ন দিয়েছেন বর্তমান সভাপতি।
এছাড়া টাঙ্গাইল থেকে ভোটার করা হয়েছে একজন ইউটিউবারকে। যিনি বুলবুলের উপদেষ্টা থাকা অবস্থায় কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্টের কারণে অব্যাহতি পেয়েছিলেন। ভোলা থেকে ভোটার করা হয়েছে বুলবুলের আরেক উপদেষ্টা, ওয়েস্টিন হোটেলের সিইও সাখাওয়াত হোসেনকে। ক্রীড়া উপদেষ্টার সঙ্গে সুসম্পর্কের পুরস্কার হিসেবে অভিযোগ তুলেছেন অনেকে এই হযবরলর মধ্যে তামিম ইকবালের নাম নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। তিনি এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে খেলা ছাড়েননি।
গঠনতন্ত্র স্পষ্ট-খেলোয়াড়ি জীবন শেষ না করলে বোর্ডকর্তা হওয়া যায় না। তবু গুলশান ক্রিকেটার্সে অর্থায়নের মাধ্যমে তিনি চেষ্টা করছেন কাউন্সিলর হতে। কিন্তু কাগজে-কলমে তিনি সভাপতি বা সম্পাদক নন, কেবল অর্থদাতা। অর্থাৎ এখানেও অনিশ্চয়তা, এখানেও বিতর্ক। এদিকে দীর্ঘদিনের সংগঠক লোকমান হোসেন ভূঁইয়াকেও দেওয়া হয়নি কাউন্সিলরশিপ।
গতকাল ছিল আপত্তি গ্রহণের দিন। নিজের বিষয়ে আপত্তি জানাতে এসে লোকমান অভিযোগ করেছেন, কমিশনের কাউকেই দেখেননি তিনি। আপত্তি গ্রহণ করছেন সিআইডির লোকজন এমনই অভিযোগ করেছেন। আজ সকাল থেকে আপত্তি গ্রহণের ওপরে শুনানি অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে বিসিবিতে। এরপরে আগামীকাল চূড়ান্ত ভোটার তালিকা প্রকাশের কথা রয়েছে।
বাংলাদেশ ক্রিকেটের ভক্তরা সবসময় চেয়েছেন মাঠে লড়াই হোক ক্রিকেটের জন্য, সংগঠকদের সততা হোক ক্রিকেটের শক্তি। কিন্তু বিসিবির নির্বাচনের এই চিত্র যেন উলটো বার্তা দিচ্ছে। স্বচ্ছতা, বিশ্বাস, প্রক্রিয়ার প্রতি শ্রদ্ধা নিয়ে অভিযোগের শেষ নেই। আছে কেবল স্বার্থের হিসাব, অভিযোগ-পালটা অভিযোগের ঝড়, আর হতাশার এক দীর্ঘ ছায়া।