
নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ পৃথককরণের ১৮ বছর পূর্তি আজ। নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ পৃথক হলেও দীর্ঘ দেড় যুগেও প্রতিষ্ঠা হয়নি বিচার বিভাগের পৃথক সচিবালয়। তবে বিচার বিভাগের জন্য সুপ্রিম কোর্টের অধীনে পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠার বিষয়ে অগ্রগতি হয়েছে। এ সংক্রান্ত খসড়া অধ্যাদেশে সম্প্রতি নীতিগত অনুমোদন দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ। এখন সচিবালয়ের আর্থিক স্বাধীনতা কার হাতে থাকবে সেই বিষয়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সচিবদের মত নিয়ে তা পুনরায় চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য উপদেষ্টা পরিষদে যাবে। সেখানে অনুমোদনের পরই অধ্যাদেশ জারি করবেন রাষ্ট্রপতি। এরপরই তা গেজেট আকারে প্রকাশ করবে আইন মন্ত্রণালয়। গেজেট প্রকাশের পরই জানা যাবে সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয়ের অধ্যাদেশে আর্থিক স্বাধীনতা কার হাতে ন্যস্ত থাকছে।
প্রসঙ্গত, ১৯৯৯ সালের ২ ডিসেম্বর মাসদার হোসেন মামলার রায়ে নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ পৃথককরণের কথা বলা হয়। ঐ রায় দেওয়ার আট বছর পর ২০০৭ সালের পহেলা নভেম্বর সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের
আমলে আমলাতন্ত্রের বাধা উপেক্ষা করে নির্বাহী বিভাগ থেকে পৃথক করা হয় বিচার বিভাগকে। কিন্তু গত ১৮ বছরেও প্রতিষ্ঠা করা যায়নি বিচার বিভাগের পৃথক সচিবালয়। এই সচিবালয় প্রতিষ্ঠা নিয়ে বিচার বিভাগ ও নির্বাহী বিভাগের মধ্যে টানাপোড়েন চলে আসছে দীর্ঘকাল ধরে।
এ প্রসঙ্গে সাবেক জ্যেষ্ঠ জেলা ও দায়রা জজ ড. মো. শাহজাহান সাজু ইত্তেফাককে বলেন, সংবিধানে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা বলতে বিচারিক কাজের পাশাপাশি আর্থিক স্বাধীনতাও নিশ্চিত করতে হবে। বিচার বিভাগের পৃথক সচিবালয়ের আর্থিক স্বাধীনতা না থাকলে ব্যয় নির্বাহের জন্য সরকারের মুখাপেক্ষী থাকতে হবে। আর সরকারের মুখাপেক্ষী হলেই বিচার বিভাগের স্বাধীনতায় সরকারের যে অদৃশ্য হস্তক্ষেপ তার প্রভাব পড়বে। সেজন্য পৃথক সচিবালয়ের আর্থিক স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে। যদি এটা করা সম্ভব না হয় তাহলে বিচার বিভাগের পূর্ণ স্বাধীনতা ও পৃথককরণ কোনোটাই অর্থবহ হবে না।
গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর প্রধান বিচারপতি পদে নিয়োগ পান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদ। দায়িত্ব নেওয়ার পর ঐ বছরের ২৭ অক্টোবর সুপ্রিম কোর্ট
থেকে পৃথক বিচার বিভাগীয় সচিবালয় গঠন সংক্রান্ত প্রস্তাব আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে পাঠান। প্রস্তাবে সংবিধানের ১০৯ অনুচ্ছেদের উদ্দেশ্য পূরণকল্পে হাইকোর্ট বিভাগ কর্তৃক অধস্তন আদালত ও ট্রাইব্যুনালের তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণ যথাযথ রূপে পালনের উদ্দেশ্যে একটি স্বতন্ত্র সচিবালয় প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে একটি অধ্যাদেশের খসড়া, প্রস্তাবিত সচিবালয়ের অর্গানোগ্রাম এবং রুল অব বিজনেস ও অ্যালোকেশন অব বিজনেসের সম্ভাব্য সংস্কার সম্পর্কে পরিপূর্ণ প্রস্তাব প্রেরণ করা হয়।
প্রস্তাবে বলা হয়, সংবিধানের ২২ অনুচ্ছেদে নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ পৃথকীকরণকে রাষ্ট্রের অন্যতম মূলনীতি হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। সংবিধানের চতুর্থ তপশিলের অন্তর্গত ‘অন্তর্বর্তীকালীন ও সাময়িক বিধানাবলির দফা ৬ (৬) অনুযায়ী অধস্তন আদালত সম্পর্কিত সংবিধানের ষষ্ঠ ভাগের ২য় পরিচ্ছেদের বিধানাবলি যথা শীঘ্রসম্ভব বাস্তবায়নের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। ঐ রূপ সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার আলোকে সুপ্রিম কোর্ট কর্তৃক প্রস্তাবিত পৃথক বিচার বিভাগীয় সচিবালয় প্রতিষ্ঠিত হলে অধস্তন আদালতের বিচারকগণের পদায়ন, বদলি, পদোন্নতি, শৃঙ্খলা, ছুটি ইত্যাদি বিষয়ে প্রচলিত দ্বৈতশাসনের অবসান ঘটবে এবং বিচার বিভাগের প্রকৃত স্বাধীনতা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।
পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব পাঠানোর পরই এ সংক্রান্ত খসড়া সুপ্রিম কোর্ট থেকে আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। সেই খসড়া কিছুটা সংশোধন করে চূড়ান্ত করে আইন মন্ত্রণালয়। যেখানে সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় নামে বিচার বিভাগের পৃথক সচিবালয়ের সার্বিক নিয়ন্ত্রণ প্রধান বিচারপতির হাতে রাখা হয়।
বিচার বিভাগের পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বড় বাধা ছিল বিদ্যমান সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদ। যে অনুচ্ছেদের ক্ষমতাবলে অধস্তন আদালতের বিচারকদের বদলি, পদায়ন, পদোন্নতি, ছুটি ও শৃঙ্খলা বিধানের কাজটি রাষ্ট্রপতির নামে আইন মন্ত্রণালয় করে থাকত সুপ্রিম কোর্টের পরামর্শক্রমে। ফলে বিচার বিভাগে এক ধরনের দ্বৈতশাসন বিরাজমান ছিল। এই দ্বৈতশাসন নিয়ে অতীতে অনেক প্রধান বিচারপতি বক্তব্যও রেখেছেন। কিন্তু দ্বৈতশাসন অবসানে প্রধান বিচারপতি সুপ্রিম কোর্টের সব বিচারকের মতামত নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারকে সরাসরি লিখিত প্রস্তাব পাঠান সরকারকে। সুপ্রিম কোর্টের লিখিত প্রস্তাব পেয়ে পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠার কাজে হাত দেয় আইন মন্ত্রণালয়।
গত ২ সেপ্টেম্বর বিচারপতি আহমেদ সোহেল ও বিচারপতি দেবাশীষ রায় চৌধুরীর দ্বৈত হাইকোর্ট বেঞ্চ এক রিট মামলায় দেওয়া রায়ে তিন মাসের মধ্যে বিচার বিভাগের জন্য পৃথক সচিবালয় স্থাপনে সরকারকে নির্দেশ প্রদান করেন। একই সঙ্গে বিদ্যমান সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদকে সংবিধান পরিপন্থি ঘোষণা করে বিচারকদের বদলি, পদোন্নতি ও শৃঙ্খলা বিধানের বিষয়টি সুপ্রিম কোর্টের হাতে ন্যস্ত করেন। যার মধ্য দিয়ে পুনরুজ্জীবিত হয় ৭২’র সালের আদি সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদ। যে অনুচ্ছেদে বিচারকদের বদলি, পদোন্নতি ও শৃঙ্খলা বিধানের বিষয়টি সুপ্রিম কোর্টের হাতে ন্যস্ত ছিল। পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে যে সাংবিধানিক বাধা ছিল হাইকোর্টের রায়ের ফলে তাও দূর হয়ে যায়। এরপর সুপ্রিম কোর্টের অধীনে বিচার বিভাগের পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে প্রণীত খসড়া অধ্যাদেশে সম্প্রতি নীতিগত অনুমোদন দিয়েছে উপদেষ্টা পরিষদ। এখন পৃথক সচিবালয় কবে প্রতিষ্ঠা হয় সেই অপেক্ষায় অধস্তন আদালতের বিচারকরা।