
বাংলাদেশে আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে স্থূলতা। আগে এ সমস্যাকে শুধু শহুরে রোগ হিসেবে দেখা হলেও এখন গ্রামাঞ্চলেও মুটিয়ে যাওয়ার প্রবণতা বাড়ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, ফাস্টফুড, কোমল পানীয় ও ভাজাপোড়া খাবারের প্রতি আকর্ষণ, অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন, দীর্ঘ সময় বসে থাকা, পর্যাপ্ত শারীরিক পরিশ্রম না করা, মানসিক চাপ, ঘুমের অভাব, হরমোনজনিত জটিলতা ও বংশগত কারণ এই সমস্যার জন্য দায়ী।
স্থূলতা শুধু বাহ্যিক সৌন্দর্য কমিয়ে দেয় না, বরং এটি বিভিন্ন জটিল রোগের ঝুঁকি বহু গুণ বাড়ায়। টাইপ-২ ডায়াবেটিস, হূেরাগ, উচ্চ রক্তচাপ, স্ট্রোক, অস্থিসন্ধিজনিত ব্যথা এবং এমনকি কিছু ক্যানসারের সঙ্গেও স্থূলতার সরাসরি যোগসূত্র রয়েছে। ফলে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা একে দেশের জন্য ‘নীরব মহামারি’ হিসেবে অভিহিত করছেন।
বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক অ্যান্ড হেলথ সার্ভের (বিডিএইচএস) সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, নারীদের মধ্যে অতিরিক্ত ওজন বা স্থূলতার হার ৪৫.৬ শতাংশ এবং পুরুষদের মধ্যে ৩২.৬৭ শতাংশ। ইউনিসেফের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ৫ থেকে ১৯ বছর বয়সি শিশুদের মধ্যে স্থূলতার হার ৯.৪ শতাংশ। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, ২০০০ সালে দেশে প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে স্থূলতার হার ছিল মাত্র ৪ শতাংশ, যা ২০২০ সালে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৭ শতাংশে। গবেষকরা আশঙ্কা করছেন, বর্তমান প্রবণতা অব্যাহত থাকলে ২০২৫ সালের মধ্যে এ হার ২৫ শতাংশ ছাড়িয়ে যাবে।
বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছে, বর্তমানে বিশ্বে ৮০ কোটির বেশি মানুষ স্থূলতায় ভুগছে। ২০৩৫ সালের মধ্যে এ সংখ্যা চার গুণেরও বেশি বেড়ে দাঁড়াতে পারে প্রায় ৪০০ কোটিতে। সবচেয়ে দ্রুত বাড়ছে শিশু ও কিশোরদের মধ্যে স্থূলতার হার, যা ভবিষ্যত্ প্রজন্মকে বড় স্বাস্থ্যঝুঁকিতে ফেলবে। সংস্থাটি সুপারিশ করেছে, প্রাপ্তবয়স্কদের প্রতি সপ্তাহে অন্তত ১৫০ মিনিট মাঝারি মাত্রার ব্যায়াম বা ৭৫ মিনিট জোরালো শারীরিক কার্যক্রম করতে হবে।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তরুণ সমাজই সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে। প্রযুক্তিনির্ভর জীবনযাপনের কারণে তারা ঘণ্টার পর ঘণ্টা মোবাইল, কম্পিউটার বা টিভি স্ক্রিনে সময় কাটাচ্ছে। ক্রীড়া ও বাইরের কার্যক্রমে অংশগ্রহণ কমে যাওয়ায় তাদের শরীরের ক্যালোরি খরচ হচ্ছে না। শিশুদের ক্ষেত্রেও বাবা-মায়ের অতিরিক্ত ওজনের প্রভাব পড়ছে।
বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিশু বিভাগের অধ্যাপক ডা. সুরাইয়া বেগম বলেন, সাধারণত দেখা যায় মোট জনসংখ্যার ৭ শতাংশ শিশু-কিশোরের অতিরিক্ত ওজন। কিন্তু মা অথবা বাবার যদি ওজন বেশি থাকে, সে ক্ষেত্রে ৪০ শতাংশ শিশু-কিশোরের ওজন বেশি হওয়ার আশঙ্কা থাকে। আর যদি দুই জনেরই ওজন বেশি থাকে, তাহলে ৭০ শতাংশ শিশু-কিশোরের ওজন বেশি হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী ইত্তেফাককে বলেন, স্থূলতার প্রধান কারণ কর্মহীন, কর্মবিমুখ, অলস জীবন যাপন, অতিরিক্ত পরিমাণ খাবার খাওয়া। পাশাপাশি বংশগত বা জিনগত কারণেও মানুষ মোটা হতে পারে। এছাড়া, কতগুলো অসুখেও মানুষ মুটিয়ে যেতে পারে। যেমন থাইরয়েড হরমোন এবং এই জাতীয় কিছু অসুখ রয়েছে—এ কারণেও মানুষ মোটা বা স্থূল হতে পারে। মেয়েদের পিসিওএস—এতে ওভারিতে ডিম্বাবানুর পরিমাণ কমে যেতে পারে। এছাড়া, স্থূলতার জন্য—হূেরাগ, উচ্চ রক্তচাপ হতে পারে, ব্রেনস্ট্রোক বেড়ে যায়, অতিরিক্ত মুটিয়ে যাওয়ার কারণে শারীরিক গতিবিধি কমে যায়, ফলে লিভারে চর্বি জমে ফ্যাটিলিভারের ঝুঁকি বেড়ে যায়। এই জনস্বাস্থ্যবিদ বলেন, সব মিলিয়ে খাবার নিয়ন্ত্রণ করে, সচল নিয়ন্ত্রিত জীবন যাপন করার মাধ্যমে শরীরটাকে কাজে লাগানো মধ্য দিয়ে আমরা স্থূলতাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি এবং পুরোটা নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে সুস্থ থাকা যায়। আর যদি কারো হরমোনজনিত সমস্যা থাকে, তখন সেই রোগগুলোর চিকিত্সা করে স্থূলতাকে নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
বিশেষজ্ঞরা আরো বলেন, স্থূলতার বিরুদ্ধে সামাজিক ও নীতিগত পদক্ষেপ জরুরি। স্কুল পর্যায়ে খেলাধুলা বাধ্যতামূলক করা, খাদ্যশিল্পকে স্বাস্থ্যবান্ধব নীতি মেনে চলতে বাধ্য করা, ফাস্টফুড ও কোমল পানীয়ের বিজ্ঞাপন নিয়ন্ত্রণ করা এবং জনসচেতনতা বৃদ্ধির জন্য জাতীয় কর্মসূচি গ্রহণ করা এখন সময়ের দাবি।