
এক সময় বাংলাদেশে সাকিব আল হাসান ছিল ঘরে ঘরে পরিচিত নাম। কোটি মানুষের কাছে তিনি ছিলেন অনুপ্রেরণার প্রতীক, আশার আলো। কেনই বা হবেন না—তিনি ছিলেন দেশের সেরা ক্রিকেটার, জাতীয় দলের অধিনায়ক, যিনি বারবার বাংলাদেশের ক্রিকেটকে তুলে ধরেছিলেন বিশ্বমঞ্চে।
দারিদ্র্য, রাজনৈতিক সহিংসতা আর প্রাকৃতিক দুর্যোগে জর্জরিত এক দেশে সাকিব হয়ে উঠেছিলেন গর্বের প্রতীক। নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের পর তিনিই সম্ভবত সবচেয়ে বেশি পরিচিত বাংলাদেশি ছিলেন বিশ্বজুড়ে।
কিন্তু ১৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে ক্ষমতায় থাকা শেখ হাসিনার পতনের পর বাংলাদেশের অনেকের কাছেই সেই সাকিব আজ আর নায়ক নন।
রাজনীতিতে প্রবেশ ও বিতর্কের শুরু
২০২৩ সালে তখনও সক্রিয় ক্রিকেটার সাকিব যোগ দেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগে এবং ২০২৪ সালের জাতীয় নির্বাচনে দলটির প্রার্থী হিসেবে অংশ নেন। নির্বাচনের ফলাফল ছিল একতরফা—বিরোধীদলবিহীন সেই ভোট নিয়ে দেশে-বিদেশে তীব্র সমালোচনা হয়।
এখন, অন্যান্য বহু আওয়ামী লীগ নেতা ও কর্মীর মতো সাকিবও রয়েছেন নির্বাসনে। সাম্প্রতিক এক ঘোষণায় জানানো হয়েছে—তিনি আর কখনো বাংলাদেশের জাতীয় দলের জার্সি গায়ে তুলতে পারবেন না। তার ক্রিকেট খেলার ওপরও নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছে। আশ্চর্যজনকভাবে, এই সিদ্ধান্তে জনগণের বড় অংশের সমর্থনও দেখা গেছে।
দুর্নীতি ও ফৌজদারি তদন্তে জড়িত
বাংলাদেশ দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) বর্তমানে সাকিব, তার মা শিরিন আখতার এবং আরও ১৩ জনের বিরুদ্ধে তদন্ত চালাচ্ছে। অভিযোগ—তারা শেয়ারবাজার কারসাজির মাধ্যমে অর্থ আত্মসাৎ, জালিয়াতি ও মানি লন্ডারিংয়ের সঙ্গে জড়িত। সাকিবের বিরুদ্ধে চেক জালিয়াতির অভিযোগও রয়েছে। এসবের কিছু অভিযোগ শেখ হাসিনা পতনের আগের, তবে আগে কখনো তা তদন্তের আওতায় আসেনি। সাংবাদিকদের অনুসন্ধানে আরও জানা গেছে, সাকিবের বাবা ছাত্র আন্দোলনের সময় সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন।
সব মিলিয়ে, একসময়ের তারকা ক্রিকেটারের পরিবার এখন গভীর সংকটে।
সাফল্য থেকে বিতর্কে
১৯৮৭ সালে মাগুরা জেলায় জন্ম নেওয়া সাকিব ২০০৪ সালে বিভাগীয় লিগে খেলা শুরু করেন। দুই বছর পর জাতীয় দলে অভিষেক। প্রায় দুই দশকের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে তিনি ৪৪৭টি ম্যাচে অংশ নিয়ে ১৪ হাজার ৭৩০ রান ও ৭১২টি উইকেট নেন। ক্রিকেট বিশ্লেষণভিত্তিক ওয়েবসাইট ইএস্পিএন ক্রিকইনফো তাকে বর্ণনা করেছে ‘বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে প্রতিভাবান ক্রিকেটার’ হিসেবে।
সাফল্যের পাশাপাশি বিজ্ঞাপন, ব্র্যান্ড চুক্তি ও সামাজিক কার্যক্রমে সাকিব হয়ে ওঠেন জনপ্রিয় মুখ। ২০১৩ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ইউনিসেফের জাতীয় শুভেচ্ছাদূতও ছিলেন তিনি। তবে তার ক্যারিয়ার কখনো বিতর্কমুক্ত ছিল না।
বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি) ও আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিল (আইসিসি) উভয়ের কাছ থেকেই তিনি একাধিকবার শাস্তি পেয়েছেন। এক গ্রাউন্ডসম্যানকে হুমকি ও টেলিভিশন ক্যামেরার সামনে অশালীন অঙ্গভঙ্গির জন্য বিসিবি তাকে আট মাসের জন্য নিষিদ্ধ করেছিল। ২০১৯ সালে এক বুকির সঙ্গে যোগাযোগ গোপন রাখায় আইসিসির দুর্নীতি দমন ইউনিট তাকে দুই বছরের জন্য নিষিদ্ধ করে, যার এক বছর ছিল স্থগিত।
এদিকে সাকিব ব্যবসায়েও মনোযোগ দেন—স্বর্ণ বাণিজ্য থেকে শুরু করে বিভিন্ন বিনিয়োগে যুক্ত হন তিনি।
ক্ষমতার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা ও পতনের সূত্রপাত
যখন সাকিব আওয়ামী লীগে যোগ দেন, তখন শেখ হাসিনার সরকার আন্তর্জাতিকভাবে কঠোর সমালোচনার মুখে—নির্বাচনে জালিয়াতি, ব্যাপক দুর্নীতি, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম, গোপন কারাগার পরিচালনা এবং বিরোধী দল দমনের অভিযোগে। দেশের অভ্যন্তরেও সবাই জানত, ক্ষমতায় টিকে থাকতে কীভাবে রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করা হচ্ছিল।
তবুও সাকিব সেই দলের সঙ্গেই যুক্ত হন।
এই সিদ্ধান্তের মাধ্যমে তিনি এমন এক পক্ষকে বেছে নেন, যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ—তারা নিজ দেশের নাগরিকদের ওপর দমন-পীড়ন চালিয়েছে। জাতিসংঘ পর্যন্ত বলেছে, ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে আন্দোলন দমনে সরকারের ভূমিকা ‘মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ’-এর পর্যায়ে পৌঁছেছিল।
নির্বাসনে সাকিব ও বিতর্কিত জন্মদিনের শুভেচ্ছা
বর্তমানে সাকিব যুক্তরাষ্ট্রে পরিবারের সঙ্গে অবস্থান করছেন। সম্প্রতি তিনি শেখ হাসিনার জন্মদিনে নিজের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি ছবি পোস্ট করে লিখেছিলেন, ‘শুভ জন্মদিন, আপা।’ সেই পোস্টের পরই সরকারের যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সাজিব ভূঁইয়া ঘোষণা দেন—সাকিবকে আর বাংলাদেশের জাতীয় দলে খেলার অনুমতি দেওয়া হবে না।
একজন মেধাবী ক্রিকেটারের স্বৈরশাসনের সঙ্গে প্রকাশ্য ঘনিষ্ঠতা শেষ করে দিয়েছে বাংলাদেশের ইতিহাসের অন্যতম উজ্জ্বল ক্রিকেট ক্যারিয়ার।
হাসিনাকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানিয়ে সাকিব দেখিয়ে দিয়েছেন, তিনি কতটা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন জনগণের আবেগ থেকে। যাদের জীবনে শেখ হাসিনার শাসন মানে ছিল রাষ্ট্রের দমননীতি, হত্যা ও নির্যাতনের প্রতীক—তাদের কাছে এই আচরণ ছিল নির্মম উপহাসের মতো। নিজের রাজনৈতিক অন্ধ আনুগত্য ও বাস্তবতা অনুধাবনে ব্যর্থতার কারণেই সাকিব নিজ হাতে তার ক্রিকেট ক্যারিয়ারের কবর খোঁড়েন।