
জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহারকারীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হচ্ছে খাবার বড়ি। বর্তমানে দেশের ২৭ শতাংশ নারী এই পদ্ধতি গ্রহণ করছেন। এর পরের অবস্থানে রয়েছে ইনজেকটেবল পদ্ধতি (১১ শতাংশ) এবং কনডম (৮ শতাংশ)। তবে জন্মনিয়ন্ত্রণে নারীর বন্ধ্যাকরণ পদ্ধতি গ্রহণের হার ৫ শতাংশ, সেখানে পুরুষদের ক্ষেত্রে হার মাত্র ১ শতাংশ।
বিশেষজ্ঞদের মতে, জন্মনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থায় পুরুষের অংশগ্রহণ কম, ফলে নারীদের ওপরেই বেশিরভাগ দায়িত্ব এসে পড়ে। এটি শুধুই স্বাস্থ্যগত নয়, একটি সামাজিক বৈষম্যের বহিঃপ্রকাশ।
তারা মনে করেন, স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক সহযোগিতা, উপকরণের সহজলভ্যতা এবং সঠিক প্রচারণা—এই তিনটির সমন্বয় ঘটাতে পারলে জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতিতে ভারসাম্য আসবে। পাশাপাশি পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার পরিবর্তন করতে না পারলে এই ভারসাম্য কখনও সম্ভব নয়।
বিশ্বজুড়ে সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ২৬ সেপ্টেম্বর পালিত হচ্ছে বিশ্ব গর্ভনিরোধ দিবস। এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের বাস্তবতাও নতুন করে আলোচনায় এসেছে।
৬৪ শতাংশ দম্পতি পদ্ধতি গ্রহণ করে, তবে বেশিরভাগ নারীই
বাংলাদেশ জনমিতি ও স্বাস্থ্য জরিপ ২০২২ (নিপোর্ট) অনুযায়ী, দেশে ৬৪ শতাংশ নারী-পুরুষ জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহার করেন। এর মধ্যে ৯১ শতাংশ নারী, আর মাত্র ৯ শতাংশ পুরুষ। অর্থাৎ নারীর ওপরই জন্মনিয়ন্ত্রণের প্রায় পুরো দায় বর্তায়।
জরিপে আরও দেখা যায়, ১০ শতাংশ নারী এমন পুরুষদের স্ত্রী, যারা জন্মনিয়ন্ত্রণে আগ্রহী হলেও উপযুক্ত তথ্যের অভাবে পদ্ধতি গ্রহণ করতে পারছেন না। এই হার ২০১১ সালে ছিল ৪২ শতাংশ, যা ২০১৭-১৮ সালে বেড়ে ৫০ শতাংশ হয়েছিল।
আর যারা আধুনিক পদ্ধতি গ্রহণ করছেন, তাদের মধ্যে ৬০ শতাংশ উপকরণ পাচ্ছেন বেসরকারি খাত থেকে—যেমন বেসরকারি হাসপাতাল, চিকিৎসক, ফার্মেসি, দোকান কিংবা বন্ধুর মাধ্যমে।
উপকরণ না থাকায় অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণ, স্বাস্থ্যঝুঁকি
সরবরাহ ঘাটতির কারণে অনেক নারী চাইলেও পদ্ধতি অনুসরণ করতে পারছেন না। যেমন ভোলার বিলকিস বেগম (৩৭)। তার চার সন্তান। খাবার বড়ি না পেয়ে গর্ভবতী হয়ে পড়েন। এখন তার ছোট ছেলের বয়স ১৯ মাস।
আরও মর্মান্তিক ঘটনা ঘটেছে ভোলারই ইলিশা ইউনিয়নের শ্রীরামপুরে। রিনা আক্তার (৪০) নামে সাত সন্তানের জননী মারা যান ১৩ সেপ্টেম্বর। তার মা জানান, রিনা খাবার বড়ি নিতে পারতেন না, আর তার স্বামী কখনোই স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে যাননি। রক্তক্ষরণ ও অপুষ্টির কারণে তিনি মারা যান, রেখে যান ছয় মেয়ে ও এক ছেলেকে।
পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের সিসিএসডিপি-র লাইন ডিরেক্টর ডা. মো. রফিকুল ইসলাম তালুকদার বলেন, ‘আমরা এখনো পুরুষদের জন্য নতুন কোনও পিল বা ট্যাবলেট আবিষ্কার করতে পারিনি। আধুনিক পদ্ধতির বেশিরভাগই নারীদের জন্য। সমাজও নারীর এই বিষয়টিকে মেয়েলি বলে চিহ্নিত করে, ফলে সচেতনতা গড়ে ওঠে না।’
উপকরণ ঘাটতি বিষয়ে তিনি বলেন, ‘দেড়-দুই বছর কিছু উপকরণে ঘাটতি ছিল, তবে এখন কিছু কিছু সরবরাহ আবার শুরু হয়েছে।’
মেরী স্টোপস বাংলাদেশ দীর্ঘদিন ধরেই প্রজনন স্বাস্থ্য সেবায় কাজ করছে। সংস্থাটির কান্ট্রি ডিরেক্টর কিশওয়ার ইমদাদ বলেন, ‘পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচিতে অনেক সফলতা রয়েছে, তবে এখনও আমরা প্রত্যন্ত অঞ্চলের নারী-পুরুষের কাছে সেবা পৌঁছাতে পারিনি। এসডিজি লক্ষ্য পূরণে প্রজনন স্বাস্থ্য সেবায় সবার প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংখ্যা বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মো. বিল্লাল হোসেন বলেন, ‘প্রায় সব পদ্ধতিই নারীদের জন্য। পুরুষদের জন্য শুধু কনডম ও ভ্যাসেকটমি রয়েছে, কিন্তু তা ব্যবহারে তারা আগ্রহ দেখায় না। পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা না পাল্টালে সমাজে পরিবর্তন আসবে না।’
এই বাস্তবতায় বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রচারণা, পুরুষদের অংশগ্রহণ, এবং উপকরণ সহজলভ্যতা—এই তিনটি বিষয়ের উন্নয়ন না হলে, জন্মনিয়ন্ত্রণের ভার নারীর কাঁধে থেকেই যাবে। যার ফল হবে স্বাস্থ্যঝুঁকি, অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণ ও সামাজিক বৈষম্য।