
বিশ্বব্যাপী পাঁচ বছরের কম বয়সি শিশুমৃত্যুর অন্যতম কারণ নিউমোনিয়া। এখনো প্রতিদিন ৭৩ শিশু নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করে। ফলে নিউমোনিয়ায় প্রতি বছর মৃত্যু হচ্ছে ২৬ হাজার ৭৬৬ শিশুর। শুধু বাংলাদেশে শিশু হাসপাতালেই নিউমোনিয়ার চিকিত্সা নিতে আসে ৮ হাজার শিশু। বিশ্বে প্রতি বছর প্রায় ৭ লাখ শিশু নিউমোনিয়ায় মারা যায়। বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক অ্যান্ড হেলথ সার্ভে (বিডিএইচএস) এবং বাংলাদেশ মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের নিউনেটোলজি ও পেডিয়াট্রিকস বিভাগের গবেষণায় এমন তথ্য উঠে এসেছে। সেখানে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে পাঁচ বছরের নিচের শিশুমৃত্যুর প্রধান কারণ নিউমোনিয়া।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, টিকার কাভারেজের মাধ্যমে শক্ত ইমিউনিটি তৈরি করতে পারলে নিউমোনিয়ার সংক্রমণ থেকে আমরাও বাঁচতে পারব। অপুষ্টি, বায়ুদূষণ ও শিশুর কম ওজন নিউমোনিয়ার ঝুঁকি বাড়ায়। শিশুকে ছয় মাস শুধু বুকের দুধ খাওয়ালে নিউমোনিয়ায় আক্রান্তের ঝুঁকি ২৩ শতাংশ কমে যায়। নিউমোনিয়া ফুসফুসের প্রদাহজনিত রোগ। এতে শ্বাস-প্রশ্বাসের কষ্ট হয়। ভাইরাস, ব্যাক্টেরিয়া, ফাঙ্গাল, ধুলাবালিসহ বিভিন্ন কারণে ফুসফুসে ইনফেকশন হয়ে, নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়। বছর জুড়ে নিউমোনিয়ার রোগী পাওয়া যায়, তবে ঋতু পরিবর্তনের সময় নিউমোনিয়ার প্রকোপ বাড়ে। ভাইরাল নিউমোনিয়া শীতকালে বাড়ে। ব্যাকটেরিয়া দ্বারা আক্রান্ত নিউমোনিয়ার জন্য কোনো সিজন নেই, ভাইরাল নিউমোনিয়া বাড়লে, ব্যাকটেরিয়া দিয়ে শুরু হওয়া নিউমোনিয়াও বাড়ে। আমাদের দেশে তেমন কোনো ডাটা নেই; তবে আমাদের এই হাসপাতালে বছরে ৮ হাজার শিশু নিউমোনিয়ার সমস্যা নিয়ে আসে; তার মধ্যে ৫ হাজার নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত বাকি ৩ হাজার ব্রংকাইটিস।
এমন পরিস্থিতিতে আজ ১২ নভেম্বর বুধবার পালিত হবে বিশ্ব নিউমোনিয়া দিবস-২০২৫। দিনটি উপলক্ষ্যে বিভিন্ন কর্মসূচি নিয়েছে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। নিউমোনিয়ার মৃত্যু ও সচেতনতা তৈরির উদ্দেশে ২০০৯ সাল থেকে বিশ্ব জুড়ে দিবসটি পালন হয়ে আসছে। নিউমোনিয়া এখনো বিশ্বব্যাপী পাঁচ বছরের কম বয়সি শিশুদের মৃত্যুর প্রধান কারণ।
বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটের শিশু পালমনোলজি বিভাগের অধ্যাপক ডা. প্রবীর কুমার সরকার ইত্তেফাককে বলেন, এখানে ঢাকার বাইরের রোগীই বেশি আসে। কারণ খারাপ রোগীগুলোকে এই হাসপাতালেই পাঠানো হয়। এই বিশেষজ্ঞ চিকিত্সক বলেন, বাংলাদেশে এখনো ৫ বছরের নিচে শিশুমৃত্যুর এক নম্বর কারণ নিউমোনিয়া। আমাদের দেশে যত শিশু মারা যায় তার এক-তৃতীয়াংশ মারা যায় নিউমোনিয়ায়। বাকি দুই-তৃতীয়াংশ মারা যায় অন্যান্য রোগে। আমাদের নিউমোনিয়ার জাতীয় যে ডাটা তাতে নিউমোনিয়ায় ৯০-এর দশকে লক্ষাধিক শিশু মারা যেত। এখন সেটা ১৪ থেকে ১৫ হাজারে নেমে এসেছে। আমাদের দেশে নিউমোনিয়ার টিকা শুরু হওয়ার ফলে মাঝখানে নিউমোনিয়া অনেক কমে গিয়েছিল। কিন্তু সম্প্রতি এটা আবার সমস্যা হিসেবে দেখা দিচ্ছে। আমরা জটিল নিউমোনিয়ার রোগী বেশি পাচ্ছি। এর কারণ হিসেবে এই বিশেষজ্ঞ বলেন, একটা কারণ অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্রান্ট। আমাদের হাসপাতালে আমরা এমন বেশকিছু রোগী পাই, যাদের জন্য আমাদের বেশি কিছু করার থাকে না। এর পাশাপাশি কত তাড়াতাড়ি আমরা নিউমোনিয়া রোগীর চিকিত্সা শুরু করতে পারছি, তার ওপরে সুস্থ হওয়াটা নির্ভর করে।
বাচ্চাকে কখন হাসপাতালে নিতে হবে :নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত সব বাচ্চাকে হাসপাতালে ভর্তি করাতে হয় না। বাচ্চার যদি শ্বাস-প্রশ্বাস বেড়ে যায়, শিশু যদি খেতে না পারে, বা যা খাচ্ছে, তাই বমি করে দিচ্ছে এবং জ্বর বেড়ে গিয়ে খিঁচুনি শুরু হয়ে গেছে এবং কোনো কারণে বাচ্চা নেতিয়ে পড়েছে—তাহলে সেই বাচ্চাগুলোকে হসপিটালে নিতে হবে বা চিকিত্সকের শরণাপন্ন হতে হবে, চিকিত্সক দেখে সিদ্ধান্ত নিবে—বাচ্চার হাসপাতালে ভর্তি লাগবে কি-না। বাবা-মায়ের করণীয় বিষয়ে জানান, শুকনা সুতি টুকরো কাপড় সঙ্গে রাখতে হবে। প্রতি ঘণ্টায় বা দুই ঘণ্টা পরপর সুতির শুকনা পাতলা কাপড় দিয়ে শিশুর মাথার পেছন, পিঠ বুক মুছে দিতে হবে। তাহলেই শিশুর ঘাম বসে গিয়ে ঠান্ডা লাগার আশঙ্কা থাকবে না। বাবা-মাকে সচেতন থাকতে হবে। নিউমোনিয়া কেবল একটা জীবাণু দিয়ে হয় না, ঠান্ডার চিকিত্সা যখন ঠিকভাবে করা হয় না, তখন কিন্তু কফ বুকে জমে গিয়ে বাচ্চার শ্বাসকষ্ট শুরু হয়।
একই হাসপাতালের রেসপিরেটরি মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মো. কামরুজ্জামান ইত্তেফাককে বলেন, নিউমোনিয়া ফুসফুসের প্রদাহজনিত রোগ। এতে শ্বাস-প্রশ্বাসের কষ্ট হয়। ভাইরাস, ব্যাক্টেরিয়া, ফাঙ্গাল, ধুলাবালিসহ বিভিন্ন কারণে ফুসফুসে ইনফেকশন হয়। নিউমোনিয়ার লক্ষণগুলো হচ্ছে—বাচ্চার কাশি থাকবে, নাক দিয়ে পানি পরবে, শ্বাসকষ্ট হবে। শিশুর শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে সঙ্গে বুকের ছাতার নিচে ওঠা-নামা করবে এবং বুকের ভেতরে এক ধরনের শব্দ শোনা যাবে। নিউমোনিয়া প্রতিরোধে এই চিকিত্সক জানান, শিশুকে ছয় মাস পর্যন্ত বুকের দুধ খাওয়াতে হবে। সময়ের আগে জন্ম নেওয়া অথবা অল্প ওজনের শিশুদের ইমিউন সিস্টেম দুর্বল থাকার কারণে ঐসব শিশু নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয় বেশি। এছাড়া যেসব শিশুর টিকা নিশ্চিত করা যায় না এবং অপরিচ্ছন্ন থাকে—সেইসব শিশু নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হতে পারে। শিশু এবং বড়দের মধ্যে যাদের ইমিউন সিস্টেম দুর্বল, তারা বেশি নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়। এছাড়া যাদের কিডনি রোগ আছে, ডায়াবেটিক, লিভার রোগে ভুগছে—তাদের নিউমোনিয়া আক্রান্তের ঝুঁকিতে থাকে।